Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিআইবিএমের সেমিনারে গভর্নর

রিজার্ভ থেকে বেরিয়ে গেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রিজার্ভ থেকে বেরিয়ে গেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এখন রয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাকি ২৪ বিলিয়ন ডলারই দেশের বাইরে চলে গেছে। যে কোনো ফরম্যাটেই হোক টাকা বাইরে চলে গেছে। বিভিন্নভাবে এসব অর্থ বাইরে গেছে। ব্যাংক থেকে টাকা পাচার হয়ে বাইরে চলে যাওয়ায় ব্যাংকে আমানত বাড়ছে না। দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ করা না গেলে ব্যাংক ও অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আসবে না।

বুধবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ব্যাংক খাতের সংস্কার বিষয়ে এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন-ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার এবং ড. হাবিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. আখতারুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইবিএমের অধ্যাপক মহিউদ্দিন ছিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএম-এর অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি।

বিআইবিএম এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন। এতে আরও বক্তব্য রাখেন-আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মেহমুদ হোসেন, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ রহমান, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাসেম মোহাম্মদ শিরিন প্রমুখ।

সেমিনারে গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের ঘটনায় ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা একে অপরকে দোষারোপ করেন। ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংক থেকে টাকা লুটের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা একেবারেই চুপ ছিলেন। তাদের সামনে দিয়েই আমানতকারীদের টাকা লুট করে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক খাতের লুটপাট প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ব্যক্তিগত তদবিরে ব্যবস্থা থাকে। ব্যক্তিস্বার্থে তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইলিং করে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। তারা আরও বলেছেন, ব্যাংক খাতের তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো ভূমিকা ছিল না। যে কারণে নজিরবিহীনভাবে লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধা দিলে বা সজাগ থাকলে এত বড় লুটপাট করা সম্ভব হতো না।

জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ভুল তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিভ্রান্ত করেছে। আমানতকারীদের টাকা লুটপাট হয়েছে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে মৌখিকভাবে জানতে চেয়ে কোনো তথ্য পায়নি। এমনকি চিঠি দিয়েও তা জানা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অপদস্থ করেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ১১ দফা চিঠি দিয়েও একটি গ্রুপের ঋণের তথ্য পাওয়া যায়নি। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর। কিন্তু তারা সেটি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন লুটপাটের ঘটনা জানতে পেরেছে। তখন ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে সেগুলো ছিল ধীরগতির। প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতে যদি আমানত বাড়াতে না পারি, ব্যাংকের টাকা যদি বাইরে চলে যায়, তাহলে ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতের প্রবৃদ্ধি হবে না। এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করার জন্য টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। সে লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগের জবাবে গভর্নর বলেন, ব্যাংক তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছুটা শৈথিল্য ছিল। এটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু ব্যাংকগুলোও লুটপাটের সময় নীরস দর্শকের ভূমিকায় ছিল। তারা লুটপাটের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়নি। অথচ আইন রয়েছে ব্যাংক খাতে আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে। কিন্তু ব্যাংকগুলো জানায়নি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। এগুলোর দায় তাদের নিতেই হবে।

গভর্নর আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। পরবর্তী অর্থবছরের মধ্যে তা ৫ শতাংশে নামানো। মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। এ লক্ষ্য অর্জনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বন্যার কারণে বর্তমান বাজারে সবজি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তি। এক সময় তা কমে আসবে। মূল্যস্ফীতির হার কমে এলে ব্যাংকের সুদ ও নীতি সুদহার কমিয়ে আনা হবে।

তিনি আরও বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর ধরেই অর্থনৈতিক খাত পিছিয়ে ছিল। অর্থনীতির চারটা স্তম্ভ ব্যাংকিং, স্টক মার্কেট, ইন্স্যুরেন্স, বন্ড মার্কেট কোনোটাই আমাদের দেশে শক্তিশালী নয়। বন্ড মার্কেট আমরা গড়েই তুলতে পারিনি। ইন্স্যুরেন্স আর স্টক মার্কেটের অবস্থা করুণ। ফলে একমাত্র ব্যাংকিং খাতকেই আমাদের দেশে বড় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উৎস বের করতে না পারলে আমাদের ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, দেশের ব্যাংকে টাকা নেই। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এখন রয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাকি ২৪ বিলিয়ন ডলারই দেশের বাইরে চলে গেছে। যে কোনো ফরম্যাটেই হোক টাকা বাইরে চলে গেছে। এখন আমানত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়নের কাজ শুরু হবে অচিরেই। তখন প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ওই সময়ে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণ শোধ করা হয়েছে। এসব প্রক্রিয়ায় রিজার্ভের বেশ কিছু অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলো সে ডলার কিনেছে। এতে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। ব্যাংকগুলোর কেনা ডলার দিয়ে আয় হয়নি। উলটো সেগুলো পাচার হয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকে আর ডলার ফেরেনি। ফলে ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার বিক্রি করে টাকাও পায়নি। যে কারণে ব্যাংকে এখন টাকার সংকট।

এদিকে সেমিনারে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদবিরে জর্জরিত বাণিজ্যিক ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক তদারকির ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। চোখের সামনে আমানতকারীদের টাকা লুট হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুই করেনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম