Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

টিআইবির দুর্নীতি ও খানা জরিপ প্রতিবেদন

দুর্নীতির শীর্ষে পাসপোর্ট সেবা

দ্বিতীয় অবস্থানে বিআরটিএ, এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা * ঘুসে এগিয়ে বিচারিক সেবা, ভূমি ও ব্যাংকিং খাত * আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেবা খাতে ঘুস ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা * দুদক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে -ড. ইফতেখারুজ্জামান

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতির শীর্ষে পাসপোর্ট সেবা

সেবা নিতে গিয়ে খানাগুলোকে গড়ে ঘুস বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা। ১৮টি ক্যাটাগরিতে জরিপে সবচেয়ে বেশি ঘুস-দুর্নীতি হয়েছে পাসপোর্ট সেবায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সেবা খাতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুস লেনদেন হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’-এর প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। টিআইবি জানায়, সেবা খাতে ২০২৩ সালে সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এছাড়া একই বছর সার্বিকভাবে ঘুসের শিকার হওয়া খানার হার ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ। গড় ঘুসের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা ও ব্যাংকিং খাতে। আর ভৌগোলিক হিসাবে ঘুস-দুর্নীতিতে শীর্ষে বরিশাল বিভাগ এবং কম হয়েছে রংপুর বিভাগে।

টিআইবির জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ৮৬ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ, যেখানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ খানা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় সেবা নিতে গিয়ে ৭৪ দশমিক ৫, বিচারিক সেবা পেতে ৬২ দশমিক ৩ এবং ভূমি সেবা পেতে ৫১ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পেতে ৪৯ দশমিক ১ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

আরও বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঘুস বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়কারী খাতগুলোর মধ্যে বিচারিক সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার ৯৭২ টাকা), ভূমি সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা), ব্যাংকিং সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৮১ টাকা) এবং বিআরটিএ সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৫৪ টাকা) ঘুস দিতে হয়েছে। এছাড়া যেসব খানার মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম, তাদের বার্ষিক আয়ের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ শুধু ঘুস হিসাবে খরচ করতে হয়। আর মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি-এমন খানার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। আর প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও হয়রানির ভয়ে দুর্নীতির শিকার খানাগুলোর অভিযোগ জানাতে অনীহা রয়েছে সেবাগ্রহীতাদের। অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে একদিকে বেশির ভাগ (৫৯.৬%) খানার কোনো ধারণা নেই, যাদের আছে (৪০.৪%) তারাও বিশেষ করে দুদক ও জিআরএস সম্পর্কে খুব কম ধারণা রাখে। অন্যদিকে যারা অভিযোগ করেছে, তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি, যা দুর্নীতির প্রতিকারে প্রবল অনীহা ও অব্যবস্থাপনাকে নির্দেশ করে।

২০২৩ সালে সরকারি ও বেসরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। এর মধ্যে ভূমি খাতে ঘুস দিতে হয়েছে ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। জলবায়ু সহায়তা পেতে ২৩ কোটি ৩ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। এছাড়াও বিচারিক সেবা পেতে ২ হাজার ৩৫৭ কোটি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে সেবা পেতে ১ হাজার ৫৭০ কোটি এবং পাসপোর্ট খাতে সেবা পেতে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হয়েছে।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবি জানায়, বাংলাদেশের খানাগুলোর সেবা গ্রহণে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপণ করতে ১৩ মে থেকে ৩ আগস্ট এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।

টিআইবির দশম এ জরিপে সারা দেশের ৮ বিভাগের গ্রাম ও শহরাঞ্চল মিলিয়ে বিভিন্ন পেশার ১৫ হাজার ৫১৫টি খানা (পরিবার) অংশগ্রহণ করে। এতে ১৮টি সেবা খাতে দুর্নীতির চিত্র তুলে আনা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, স্বাস্থ্য (সরকারি), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), গ্যাস, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা, বিদ্যুৎ, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), কৃষি, কর ও শুল্ক, বিমা, ব্যাংকিং, এনজিও (প্রধানত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ) ও অন্যান্য (এমএফএস, ওয়াসা, অনলাইন শপিং ইত্যাদি)।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ জরিপের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণ সেবা নিতে গিয়ে যে দুর্নীতির শিকার হয় তার ধরন, ব্যাপকতা ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য সরকার, নীতিনির্ধারক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য অংশীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যেন তারা জরিপের ফলাফল এবং এর ওপর ভিত্তি করে টিআইবি প্রণীত সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।

তিনি বলেন, জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, বিচারিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুসের উচ্চহার অব্যাহত, যা সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমি সেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএ-এর মতো সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুস বিদ্যমান, যা মানুষের প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োজনীয় সেবাপ্রাপ্তির অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এজন্য ৩০ শতাংশ মানুষ দুদক সম্পর্কে জানলেও দুর্নীতির শিকার হয়ে মাত্র ০.৬ শতাংশ মানুষ অভিযোগ দায়ের করেছে। ভুক্তভোগীদের অভিমত, অভিযোগ জানালেও দুদক থেকে তারা কোনো প্রতিকার পাবেন না।

টিআইবির সুপারিশ : জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ করেছে টিআইবি। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. সেবা খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

২. সেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজ করতে হবে; যেন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন না হয়। অনলাইনে সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে যথাযথ প্রচারণা চালাতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করা এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

৩. সেবাদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাদাতার জন্য যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন করা; যেখানে কোন সেবা কীভাবে ও কত সময়ের মধ্যে দিতে হবে, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে। প্রত্যেক সেবা গ্রহণের পর সেবাদাতার মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা করা।

৪. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেধা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি, পদায়নের ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা।

৫. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদে সেবার মূল্য ও সেবাপ্রাপ্তির সময় সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যকর করা, যেখানে সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।

৬. যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয়, সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করা; কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৭. সেবা খাতে গ্রাহক হয়রানি বন্ধ এবং অভিযোগ নিরসনব্যবস্থা অংশ হিসাবে ‘গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস)’ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

৮. সেবাদাতা সব প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা। পাশাপাশি এসএমএস, ই-মেইল, ওয়েবসাইট ইত্যাদির মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করা।

৯. অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার রেজিস্টার সংরক্ষণ করা এবং অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

১০. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষার মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করা।

১১. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদবিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে হালনাগাদ করে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। দাখিলকৃত সম্পদবিবরণী সম্পর্কে কোনো অভিযোগ এলে তা যাচাই করা; কোনো ধরনের অসংগতি পাওয়া গেলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।

১২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম