সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও জামায়াত তৎপর
মাঠ গোছাচ্ছে দুই দল
ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনা তুলে ধরছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। প্রাধান্য বিগত নির্বাচনের প্রার্থী, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা * দুই ধরনের প্রস্তুতি চলছে। নিজেরাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। তারিখ ঘোষণার পর পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে একক না জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন চায় দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। একই দাবি জামায়াতে ইসলামীরও। ইতোমধ্যে দুই দলের নেতারা দল গোছানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠও গোছাচ্ছে দল দুটি। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনি আসনে এখন সক্রিয়। নেতারা জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয়। ঐক্য ও শান্তির বার্তা দেওয়ার সঙ্গে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতিও। মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে নির্বাচনি প্রচারণার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। দলের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও চিন্তাভাবনা তুলে ধরছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। নীতিনির্ধারকদের মতে, প্রার্থী নির্ধারণে প্রাধান্য পাবেন বিগত নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলীয় প্রার্থী, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা। তবে একক নাকি জোটবদ্ধভাবে অংশ নেবে, তা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চূড়ান্ত হবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতের দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রথমত, জামায়াত নিজেরাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় যখন আসবে, তখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করবে, তার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কাজেই এককভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে, তা এখনই বলার সুযোগ নেই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। এরই মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সরকার। তবে সেটি সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
দেশে গত কয়েকদিনে নৈরাজ্যের প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি ও জামায়াত। এতে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন দল দুটির নেতারা। পাশাপাশি দেশের শান্তি বিনষ্টকারী শক্তিকে প্রতিহত করতে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য গঠনে উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সেখানে তুলে ধরেছেন দ্রুত সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা। ন্যূনতম সংস্কারগুলো সম্পূর্ণ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনমুখী দল হিসাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি প্রস্তুতি সবসময়ই দলের থাকে এবং সে অনুযায়ীই এখন তারা কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি সবসময়ই আমাদের ছিল এবং এটি থাকেও। তবে সময়ে সময়ে এর নানাদিক আপডেট কিংবা কিছু পরিবর্তন হয়। সেগুলো আমরা করছি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনায় রেখে দলের কার্যক্রম এখন এগোচ্ছে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অর্থাৎ জাতীয় সরকার করে দল পরিচালনা করা হবে। যেসব দল আন্তরিকভাবে বিএনপির সঙ্গে ছিল, তারাও সেই সরকারে থাকবে। ফলে নির্বাচনি প্রস্তুতিতেও এ বিষয়টিও নিঃসন্দেহে বিবেচনায় থাকবে।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছি, এগুলো ছাড়া সব নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণও করেছি। নির্বাচনি দল হিসাবে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের বক্তব্য জামায়াতে ইসলামীর আমির পরিষ্কার করেছেন, ন্যূনতম যে সংস্কার দরকার, আমরা চাই এ সংস্কারগুলো দ্রুত করা দরকার। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে দেওয়া উচিত।
বিএনপি : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দল গোছানোর পাশাপাশি আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে বিএনপিতে। ইতোমধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে তৃণমূলের কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এজন্য ঢাকা ছাড়া নয় সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৯ সিনিয়র নেতাকে। এছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ইতিবাচক রাজনীতির বার্তা নিয়ে সারা দেশ সফর করছে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। এর পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় সভাসহ নানা কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। তারা জনসংযোগ, জনস্বার্থে কর্মসূচি পালন করছেন। পাশাপাশি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। বিএনপি ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও চিন্তাভাবনা তুলে ধরছে সাধারণ মানুষের কাছে।
নেতারা জানান, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা দলের নেতাদের পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে সহায়তার জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে বিএনপি জিতলে ‘সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন’ এবং ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট’-এর ঘোষণা দিয়েছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এখন সম্ভাব্য সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে বিএনপির প্রস্তুতি ও কর্মকাণ্ডে সেটিই প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে জোটবদ্ধ না এককভাবে নির্বাচনে যাবে, তা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরই সিদ্ধান্তে নেবে দলটি।
মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো দেশবাসীর মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছে। আগামী দিনের বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য তার অপেক্ষায় দেশবাসী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে জনসম্পৃক্ত সব ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচনি আসনের মানুষের সঙ্গে আমার একটা আত্মার সম্পর্ক। যে কারণে সবসময়ই এলাকার দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ সুখ-দুঃখে পাশে পেয়েছেন, এখনো পাশে থাকার চেষ্টা করছি।
ঢাকা-১৬ আসনে নানা ইতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক। তিনি বলেন, জনগণকে বার্তা দিচ্ছি-আওয়ামী লীগ ১৬ বছরে যা করেছে, বিএনপি ঠিক এর উলটোটা করতে চায়। আমরা চাই, বাংলাদেশে যেন আর স্বৈরাচারের জন্ম না হয়। বাংলাদেশের মাটিতে যাতে একটি স্বচ্ছ ধারার রাজনীতির পরিবেশ তৈরি হয়। এখানে কোনো প্রতিহিংসা থাকবে না, কোনো ভাইকে রক্ত দিতে হবে না, কাউকে গুম করা হবে না।
টাঙ্গাইল-৩ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বার্তা জনগণকে পৌঁছে দিচ্ছি। জনগণও তা গ্রহণ করছে, প্রশংসা করছে। তারা দ্রুত নির্বাচন চায়।
জামায়াতে ইসলামী : এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনি কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও নির্বাচনি মাঠ গোছাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে মাঠে সরব রয়েছে তারা। জানা যায়, তাদের মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে ইতিহাস সৃষ্টি করা। সেজন্য এখন থেকে মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমত তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দলটি। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নানা দলীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। দলটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতের দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রথমত, জামায়াত নিজেরাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় যখন আসবে, তখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করবে, সেই পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এককভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে, তা এখনই বলার সুযোগ নেই।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে ১৬ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে জামায়াতে ইসলামী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ মুহূর্তে সারা দেশে দলটি ঘরোয়া কার্যক্রমে ব্যস্ত। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে একক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে দলীয় প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নেতারা বলছেন, এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে সারা দেশেই নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সরব রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে যেসব নির্বাচনি আসনে ভালো করতে পারবে, সেসব আসনে প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এসংক্রান্ত কমিটিগুলোর নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। বৈঠক থেকে জেলাগুলোর দায়িত্বে থাকা নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যেসব আসনে প্রার্থী এখনো বাছাই হয়নি, সেখানে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় নতুন প্রার্থী যোগ-বিয়োগ করছে এ কমিটি।
জামায়াতে ইসলামীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে তাদের দুই শতাধিক আসনে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বাকি আসনের প্রার্থী তালিকা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। তবে নির্বাচনের সময় বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে ইসলামী দলগুলো নিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার জন্যও একটি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দল দুটি অংশ নিয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি ও জামায়াত।