চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সম্মেলনে তারেক রহমান
নির্বাচন যত দেরিতে হবে ততই ষড়যন্ত্র বাড়বে
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয় * দেশে ফ্যাসিবাদের জনক শেখ মুজিবুর রহমান : মির্জা ফখরুল
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশের নির্বাচন যত দেরি হবে, ততই ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পাবে। জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার বিরুদ্ধে দেশের লক্ষ-কোটি মানুষ এক যুগের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছেন, সেই স্বৈরাচার কিন্তু বসে নেই। সেই স্বৈরাচার তাদের দেশি-বিদেশি প্রভুদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। তাই দেশ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সংস্কারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য আমরা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। শুধু আমরাই নই, বিভিন্ন দল দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে উপদেষ্টারা যেসব সংস্কারের কথা বলছেন, এগুলো সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়ন সম্ভব যদি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। এর বাইরে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সেজন্য জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। শনিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা টাউন ফুটবল মাঠে আয়োজিত জেলা বিএনপির সম্মেলনে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কেন নির্বাচন চাইছেন তারও ব্যাখ্যা দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, নির্বাচন যত দেরিতে হবে, এই দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুবিধা, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষকদের সমস্যা, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমস্যা, বিচার ব্যবস্থার সমস্যা, প্রশাসনের সমস্যা, যতগুলো সমস্যা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ করে গিয়েছে, তা আরও বৃদ্ধি যাবে। একমাত্র একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব ধীরে ধীরে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান করা।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সক্ষম মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সক্ষম হলেই প্রকৃত ব্যক্তিগুলো নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন। যারা সত্যিকার অর্থেই জনগণের কথা বলবেন, জনগণের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করবেন। প্রতিটি সেক্টরের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে চিন্তা করবেন। একটি প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে যদি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন, তাহলেই একমাত্র সম্ভব।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা বাংলাদেশের এবং দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য ৩১ দফার একটি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। আজকে অনেক ব্যক্তি বা সংগঠন সংস্কারের কথা বলছে, আজকের অন্তর্বর্তীকালীন যে সরকার তারাও সংস্কারের কথা বলছে। কিন্তু এই সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপিই দেশের মানুষের সামনে প্রথম হাজির করেছে। কারণ বিএনপি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য চিন্তা করে বলেই ২ বছর আগে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। কিছু কিছু সংস্কারের কাজ এই সরকার অবশ্যই শুরু করতে পারে। আমরা চাইও তারা শুরু করুক। কিন্তু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একজন শুরু করবে, বাকিরা সেই সংস্কারকে চলমান রেখে সামনে নিয়ে যাবে। কারণ দেশের মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কার পরিবর্তিত হবে সময়ে সময়ে।
বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, দেশবাসী বিএনপিকে দায়িত্ব দিতে চায়। দায়িত্ব নিতে হলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়ার মতো নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। আসুন সবাই মিলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আমরা যে যেই পর্যায়ের নেতা বা কর্মী হয়ে থাকি না কেন, সেটা বড় কথা না। আপনি একজন বিএনপির কর্মী, আপনি একজন শহিদ জিয়ার সৈনিক। তাই সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার কাছে আপনার এলাকার মানুষের প্রত্যাশা কী এবং তা অনুধাবন করে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমাদের সংগঠনকে গড়ে তুলতে সম্মেলন যেমন প্রয়োজন, প্রকৃত নেতৃত্ব ও ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতেও সম্মেলন প্রয়োজন। একইভাবে বাংলাদেশকে যদি গড়ে তুলতে হয়, মানুষের ভাগ্যের যদি পরিবর্তন করতে হয়, সেই কাজ যদি শুরু করতে হয়, আবার যদি আমাদের খাল খনন কর্মসূচি শুরু করতে হয়, শিল্পবিপ্লব শুরু করতে হয়, কৃষকের সমস্যার সমাধান করতে হয়-অবশ্যই দরকার প্রকৃত জনপ্রতিনিধি। যারা দেশের স্বার্থে কথা বলবে, মানুষের কথা বলবে এবং তার জন্য প্রয়োজন নির্বাচন। এই কথাটা পরিষ্কারভাবে আজকে আমাদের তুলে ধরতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে। তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে। কারণ, পৃথিবীতে যেসব গণতান্ত্রিক দেশ আছে, তারা এই গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে তাদের দেশের অনেক সমস্যার সমাধান করেছে।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। মহাসচিবসহ নেতারা মঞ্চে আসন গ্রহণের পর জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) পরিবেশনায় দলীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, তরুণদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। দেশ এবং জাতির জন্যই নির্বাচন দরকার। তরুণদের অবশ্যই জায়গা করে দেব আমরা। কিন্তু সেই তরুণদেরকেও একইসঙ্গে সবাইকে নিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে হবে। এখন অনেক নব্য নেতৃত্ব মাঝেমধ্যে হুমকি দিচ্ছে। সব সংস্কার না করে নির্বাচন দেবে না। আমরা বলতে চাই, নির্বাচন বিএনপি শুধু বিএনপির জন্য চায় না। বিএনপি নির্বাচন চায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য।
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, আওয়ামী লীগ কখনোই গণতান্ত্রিক দল ছিল না। তারা ফ্যাসিবাদী দল। তাদের বডি কেমিস্ট্রিতে গণতন্ত্র নেই। ১৯৭২-১৯৭৫ সালে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেন শেখ মুজিব। এ দেশে ফ্যাসিবাদের জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহমুদ হাসান খান বাবুর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব শরীফুজ্জামানের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ও নিতাই রায় চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু, মেহেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ ও সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদসহ জাতীয় ও স্থানীয় নেতারা।
পর্যায়ক্রমে গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হব : রাজশাহী ব্যুরো জানায়, শনিবার বিকালে রাজশাহী জেলা পরিষদ মিলনায়তনে দিনব্যাপী ‘বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালা’ হয়। এ কর্মশালার আয়োজন করে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক কমিটি। এতে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘বিগত স্বৈরাচারের সময় আমাদের প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে। এটি গায়েবি মামলা নামে সারা দেশে পরিচিত। অবশ্যই আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে কথা বলছি। এটি একটি আইনগত প্রক্রিয়া, চলমান প্রক্রিয়া এটি। একবারে হয়তো সম্ভব হবে না। পর্যায়ক্রমে আমরা গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করাব বা করাতে সক্ষম হব।’
এতে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার নেতাকর্মীরা অংশ নেন। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের জন্য নিজের ৩১ দফার বিষয়ে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বগুড়ার অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানান, বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে আনছে, কিন্তু আদালতে সঙ্গে সঙ্গে জামিন হচ্ছে। অথচ আগে বিএনপির নেতাকর্মীর জামিন হয়নি এত দ্রুত। এই বিচারকদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওদের পার্থক্যটা এখানেই। আমরা যে বৈষম্যের শিকার হয়েছি, সেটিকে আমরা ভাঙতে চাই।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, ইসমাইল জবিউল্লাহ, নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিএনপি নেতা ড. মাহাদী আমিন প্রমুখ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। কর্মশালায় আলোচনা করেন বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রাশিদা বেগম হীরা ও কৃষক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিব। সভাপতিত্ব করেন বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত। বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এবিএম মোশাররফ হোসেনের সঞ্চালনায় কর্মশালায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন-কেন্দ্রীয় নেতা ওবায়দুর রহমান চন্দন, আমিরুল ইসলাম আলীম, আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী, রেহেনা আক্তার বানু, নেওয়াজ হালিমা, শফিকুল হক মিলন প্রমুখ।