বিদ্যুতের তারে জড়াল পিকনিকের বাস
শ্রীপুরে আইইউটির তিন শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু
দুই তদন্ত কমিটি গঠন
গাজীপুর ও শ্রীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকে যাওয়ার পথে বিআরটিসির একটি দোতলা বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। তারা গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত তিন শিক্ষার্থী হলেন-ফেনী জেলার মাস্টারপাড়া এলাকার মোতাহার হোসেনের ছেলে মোজাম্মেল হোসেন নাঈম (২২), রংপুর সদরের ইমতিয়াজুর রহমানের ছেলে মোস্তাকিম রহমান মাহিন (২২) ও রাজশাহী জেলার রাজপাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে জোবায়ের আলম সাকিব (২৩)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় নাফিজ আলম (২২) ও কাবিজুল ইসলাম আলীফ (২২) নামে দুই শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ এলাকায় ‘মাটির মায়া’ রিসোর্টে যাওয়ার পথে বাসটি সড়কের ওপর বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সংস্পর্শে আসে। এতে ভেতরে থাকা অনেকেই বিদ্যুতায়িত হন। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। বিআরটিসির ছয়টি বাস শিক্ষার্থীদের নিয়ে পিকনিক স্পটের দিকে যাচ্ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী উদয়খালী গ্রামের জহিরুল ইসলাম বলেন, পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েকটি বিআরটিসির দোতলা বাস যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি বাস বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হতে থাকে। এ সময় তাড়াহুড়া করে বাস থেকে নামার সময় একজন তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। অপর দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাদের মৃত্যু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, ছয়টি দোতলা বিআরটিসি বাস ও তিনটি মাইক্রোবাস ৪৬০ শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে তেলিহাটি ইউনিয়নের পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া নামক রিসোর্টে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উদয়খালী এলাকায় পৌঁছালে একটি বাস রাস্তার পাশে ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তারে জড়ালে ছয়জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে মাহিন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যারিস্টার সজীব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এ দুর্ঘটনার পর শোকাহত শিক্ষার্থীরা পিকনিকের সব কার্যক্রম স্থগিত করে শুধু মধ্যাহ্নভোজের পর সুশৃঙ্খলভাবে পিকনিক স্পট ত্যাগ করেন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারও গাফিলতি বা অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকলে, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আহতদের বিভিন্ন ক্লিনিকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিহত এবং আহতদের আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে নিহত এবং আহতদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক জাকিউল ইসলাম সেখানে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর উপমহাব্যস্থাপক খন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, ১১ হাজার বোল্টের ওই বৈদ্যুতিক লাইনটি দুর্ঘটনাস্থলে সড়ক ক্রস করা অবস্থায় ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত দোতলা বাসটি অপর একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে একদিকে বেশি কাত হওয়ায় অপর অংশ ওপরে উঠে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যায়।
পিকনিকে আসা শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রিসোর্ট ও পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পিকনিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন তারা। এখানে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও আইটি বিভাগের ৪৬০ শিক্ষার্থী। তারা অভিযোগ করেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে গ্রামীণ আঞ্চলিক এক লেনের সরু সড়কে যেখানে মিনিবাস চলাই কঠিন, সেখানে কী করে বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাস প্রবেশ করানো হলো? পিকনিক স্পট বুক করার আগে আঞ্চলিক সড়কে ডাবল ডেকার বাস ঢুকবে কিনা সেটা আগে থেকেই জানা দরকার ছিল। কিন্তু তারা এসব বিষয় চিন্তাতেই আনেননি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষও বিষয়টি পিকনিক আয়োজকদের জানাননি। এ ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। এদিকে স্থানীয়রা বলেন, পল্লী বিদ্যুতের তারটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। আমরা খুব ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম। আজ পল্লী বিদ্যুৎ যদি তারটি খোলা না রেখে কভার তার ব্যবহার করত তাহলে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটত না।
উপজেলার এক গ্রামীণ পরিবেশে মাটির মায়া রিসোর্টটির অবস্থান। রিসোর্টির বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই। স্থানীয় আমিনুল ইসলাম বলেন, রাতেও রিসোর্টটিতে উচ্চ শব্দে চলত গানবাজনা। আমরা গানবাজনার শব্দে অতিষ্ঠ।
এ বিষয়ে জানতে রিসোর্টটির ব্যবস্থাপক মাসুদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। শ্রীপুর থানার ওসি মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন মন্ডল বলেন, এ ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দায়ের করেননি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।