বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ
ব্যাংক খাতে ডলারের স্থিতি কমেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগের বকেয়া ও স্থগিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলারের স্থিতি কমে গেছে। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা ধারণের স্থিতি কমেছে ২২ দশমিক ০৮ শতাংশ।
এদিকে ডলারের বিপরীতে আগের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়নের হার কমেছে। তবে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ও রপ্তানি প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা কমানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত সরকারের আমলে ডলার সংকটের কারণে স্থগিত ও বকেয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে ডলারের স্থিতি কমেছে। গত বছরের আগস্টে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ছিল ৫৮০ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫২৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
ওই সময়ে কমেছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ৬১৭ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৯৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে ডলারের স্থিতি কমেছে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে ছিল ৫৯২ কোটি ডলার, অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬২ কোটি ডলার। ওই সময়ে স্থিতি কমেছে ২২ দশমিক ০৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বিগত সরকারের স্থগিত ও বকেয়া দেনা পরিশোধ করতে শুরু করেছে। গত সরকার ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। অক্টোবর পর্যন্ত সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করেছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করেছে ৩০০ কোটি ডলার।
মোট ৫০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি। এছাড়া আমদানির নিয়মিত দেনা শোধ করা হচ্ছে। তবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা শোধ করা হচ্ছে রিজার্ভ থেকে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আকুর দেনা শোধ করা হয়েছে রিজার্ভ থেকে। ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমে গেছে।
এদিকে চাহিদার তুলনায় ডলারের প্রবাহ এখনও কম থাকায় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না। তবে টাকার অবমূল্যায়ন আগের তুলনায় কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে অবমূল্যায়ন হয়েছে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে অবমূল্যায়ন কমেছে দশমিক ২৭ শতাংশ।
এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার ও সাধারণ বিনিময় হারের সূচক বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দুই ধরনের দর নির্ধারণ করে। একটি প্রকৃত ও অপরটি সাধারণ। বাজারে যেটি চলমান সেটি সাধারণ দর। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপরীতে টাকার মানের প্রকৃত অবস্থা জানতে একটি দর নিরূপণ করে সেটি হচ্ছে প্রকৃত বিনিময় হার।
টাকার বিপরীতে ১৮টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে একটি কারেন্সি বাস্কেট তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওইসব দেশের রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে এর দাম নিরূপণ করা হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি সূচক ১০০ ধরে এর মূল্য নিরূপণ করা হচ্ছে।
প্রকৃত বিনিময় হারের সূচক সেপ্টেম্বরে ছিল ১০০ দশমিক ৪০ পয়েন্ট। অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট। সাধারণ বিনিময় হারের সূচক সেপ্টেম্বরে ছিল ৬৯ দশমিক ৩১ পয়েন্ট ও অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ দশমিক ০১ পয়েন্টে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এখন ডলারের সাধারণ বিনিময় হার ১২০ টাকা ও প্রকৃত বিনিময় হার ১২৩ দশমিক ৫৭ টাকা। সাধারণ ও প্রকৃত বিনিময় হারের মধ্যে সব সময়ই একটু পার্থক্য থাকে। এপ্রিলে এ পার্থক্য বেশি মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে এ ব্যবধান কমছে। মে মাসের এ ব্যবধান কমে সমান হয়ে যায়। জুন পর্যন্ত তা সমান থাকে। এরপর থেকে ব্যবধান আবার বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরের পর থেকে ব্যবধান আবার বাড়তে শুরু করেছে।
সাধারণত প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে বাজারে ডলারের দর একটু বেশি থাকে। কারণ রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের বাড়তি বা কারেন্সি সুবিধা দিতে এটি করা হয়। কিন্তু এখন প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে বাজার দর কম। গত সরকারের আমলে অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রকৃত অবস্থা গোপন করে কৃত্রিম তথ্য দিয়ে সূচক তৈরি করায় এ খাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে এখন সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রবণতাও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত অর্থবছরের জুলাই অক্টোবরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে ৪৩৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রি করেছে ৭২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। ওই সময়ে ডলার বিক্রি কমেছে ৬ গুণ।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। এ কারণে এর দামও কমেছে। ব্যাংকে আমদানিতে আগে ডলার বিক্রি হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকায়। এখন তা সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। নগদ ডলার ব্যাংকে আগে ছিল ১২৩ টাকা, এখন সর্বোচ্চ ১২১ টাকা। খোলা বাজারে এখন প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২২ থেকে ১২৩ টাকা। আগে ছিল সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা। তখন ব্যাংকে ছিল ১১৮ টাকায় ওই সময়ে ব্যবধান ছিল ১৪ টাকা। এখন ব্যবধান হচ্ছে ১ থেকে ২ টাকা।