সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা
দেশরক্ষায় প্রস্তুত সশস্ত্র বাহিনী
ছাত্র আন্দোলনে সশস্ত্র বাহিনী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে আস্থার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কোনো আগ্রাসী বহিঃশক্তির হাত থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী সদা প্রস্তুত। সে লক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর পুনর্গঠন, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্যোগ চলমান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সশস্ত্র বাহিনী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে আবারও মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সব ক্ষমতার মালিক। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত প্রধান উপদেষ্টাসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান। এবারের আয়োজনে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল দীর্ঘ এক যুগ পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতি। এর আগে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
ড. ইউনূস বলেন, যে কোনো আগ্রাসী বহিঃশক্তির হাত থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা সদা প্রস্তুত এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সেলক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর পুনর্গঠন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বাহিনীগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তির সংযুক্তির প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এ সময় জাতিসংঘ মিশন দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে বলে সশস্ত্র বাহিনীকে ধন্যবাদ দেন তিনি।
বলেন, বর্তমানে ১২টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছে। বিশেষভাবে বাংলাদেশ অন্যতম নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে জীবন দিয়ে যারা দেশগঠনের সুযোগ দিয়েছেন, জাতি তাদের আজীবন স্মরণ করবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবং পরবর্তী সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ছাত্র-জনতা ও সাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সব ক্ষমতার মালিক। মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সব মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারও উপরে না। আবার কেউ কারও নিচেও না। এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ছাত্র-জনতার সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্প্রতি আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ অর্জন করেছি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে, এর মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী যে উদ্যোগ প্রতিবছর নিচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বীর শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন : সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সব বীর শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকশ দল প্রধান উপদেষ্টাকে সালাম জানান। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। প্রধান উপদেষ্টা সেখানে রাখা দর্শনার্থীদের বইয়েও স্বাক্ষর করেন। এর আগে শিখা অনির্বাণে পৌঁছলে সেখানে তিন বাহিনীর প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধ্যাপক ইউনূসকে স্বাগত জানান।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও নৌ সদস্যদের পদক প্রদান : দিবসটি উপলক্ষ্যে নৌবাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত ২২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালে ৪০ জন এবং ২০২৪ সালে ৩৭ জনসহ মোট ৭৭ নৌসদস্যকে শান্তিকালীন পদক দেওয়া হয়। এ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার নৌ সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান সম্মাননা স্মারক ও পদক তুলে দেন।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত : এদিকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত হয়েছে। প্রতিবছর ২১ নভেম্বর দেশে দিবসটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। ফজরের পর দেশের সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ও স্থাপনা এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর শহিদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এরপর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া তিন বাহিনী প্রধান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা স্মারক বিতরণ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী, তিন বাহিনী প্রধান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অসামরিক ও সামরিক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সংবর্ধনায় উল্লেখযোগ্য আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি, সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, মুখ্য সচিব, বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক প্রধান, সামরিক সাবেক কর্মকর্তা, স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীরশ্রেষ্ঠের উত্তরাধিকারী, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা এলাকায় বসবাসরত খেতাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তাদের উত্তরাধিকারী, উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা এবং তিন বাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
এছাড়া ঢাকা, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামে বিশেষভাবে সজ্জিত নৌবাহিনীর জাহাজ বেলা ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বসাধারণের দেখার জন্য নিকটস্থ ঘাটগুলোয় নোঙরকৃত উন্মুক্ত রাখা হয়।