ভারত থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ
আদানির চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে কমিটি গঠনের নির্দেশ
কমিটিতে আন্তর্জাতিক জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সংগৃহীত
বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটিতে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশেষজ্ঞ রাখতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠন করে পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ নিয়ে আদানি গ্রুপের সঙ্গে অসম চুক্তি বাতিল করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির সময় যে দরকষাকষি হয়েছিল, তার নথিও এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। এদিন আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এম আব্দুল কাইয়ুম। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট আফরোজা ফিরোজ মিতা, ব্যারিস্টার কামারুন মাহমুদ দীপা ও ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান। এর আগে বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে সব চুক্তি বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ব্যারিস্টার এম কাইয়ুম জনস্বার্থে রিটটি করেন। ৬ নভেম্বর আদানি গ্রুপের সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল চেয়ে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। ৩ দিনের মধ্যে চুক্তি পুনর্বিবেচনার কার্যক্রম শুরু না করলে হাইকোর্টে রিট করবেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। নোটিশের জবাব দিতে পিডিবির চেয়ারম্যান ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ৩ তিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। নোটিশের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় এ রিট আবেদনটি করা হয়েছে।
জানা যায়, বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনায় আদানির সঙ্গে তাড়াহুড়া করে ২০১৭ সালে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়। ওই সময় দেশে আমদানি করা কয়লানির্ভর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়নি। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডে আদানির ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মূলত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির সভায় ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত ও নথি কমিটিকে সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভারতের আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জানা যায়, আদানির সঙ্গে চুক্তির ফলে পিডিবি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চুক্তির অন্যতম একটি শর্ত হলো উৎপাদিত বিদ্যুৎতের অন্তত ৩৪ শতাংশ বাংলাদেশকে কিনতে হবে। অর্থাৎ পিডিবির চাহিদা যদি কমও থাকে বা বিদ্যুৎ নাও আনা হয়, তারপরও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার খরচ দিতে হবে। একইসঙ্গে গুনতে হবে কয়লা সরবরাহকারী, পরিবহণকারী ও বন্দর অপারেটরদের সব জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বয়লার, টারবাইন ও জেনারেটর কত ঘণ্টার জন্য চালানো হচ্ছে, সে অনুপাতে প্রতিবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একটি ভাড়া দিতে হয়। যেখানে পায়রা ও রামপালের কর্তৃপক্ষ তাদের মূলধন ব্যয়, ইক্যুইটি রিটার্ন, ঋণের সুদ, অবমূল্যায়ন, কার্যকরী মূলধনের সুদ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে একটি চার্জ নির্ধারণ করেছে, সেখানে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তিতে স্বেচ্ছাচারী একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ না নিতে পারে, ক্যাপাসিটি চার্জ ও জরিমানাসহ সব ধরনের পাওনা তাদের দিতে হবে। কিন্তু একই কারণে তারা যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে পিডিবিকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য নয়। রাজনৈতিক কোনো কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে তাদের ধরা যাবে না। তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ, বিদ্যুতের দামসহ অন্যান্য বকেয়া পরে পরিশোধ করতে হবে।
চুক্তির আরেকটি অযৌক্তিক ধারা হলো-রাজনৈতিক কোনো কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেটা মেরামত ও সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় পিডিবিকে দিতে হবে। রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই সম্পূরক খরচ দিতে হবে না। এই খরচের কারণেও আদানির বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যেতে পারে।
আদানির জন্য আরেকটি সুবিধাজনক ধারা হলো গ্রিডে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য প্রথমবারের পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে পারার সুবিধা। এদিকে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার গোপনীয় চুক্তির দায় এসে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। নিয়ম অনুযায়ী, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমদানিসংক্রান্ত চুক্তির আগে এনবিআরের মতামত নিতে হয়। কিন্তু আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে তা একেবারেই অগ্রাহ্য করা হয়। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অসম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু তা উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ নিজেরাই শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে চুক্তি করে। এতে সরকার সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে এমন অনেক শর্ত রয়েছে, যেগুলোর কারণে ২৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়ে যাবে কোম্পানিটি। সে হিসাবে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে বাংলাদেশের।
আদানির সঙ্গে পিডিবির করা চুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুরো চুক্তিই এমনভাবে সাজানো, যাতে আদানি গ্রুপ সুবিধা পায়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি ৩ মাস পর কত বিদ্যুৎ নেবে, তা আগেই ঘোষণা করতে হবে। যদি বাংলাদেশ এর চেয়ে কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ঘোষিত পরিমাণের সমান দাম পরিশোধ করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলোর কাছ থেকে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু বিদ্যুৎ নেয় পিডিবি। এ জন্য ৩ মাস আগে চাহিদাও পাঠাতে হয় না।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানি ইচ্ছা করলেই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে। তৃতীয় পক্ষের কাছে কেন্দ্রটি যদি বেশি দাম পায়, তাহলে তারা সেখানে বিদ্যুৎ বিক্রি করে দিলে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতে বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন হয় গ্রীষ্মকালে। এখন আদানি যদি গ্রীষ্মে ভারতে বিদ্যুৎ দেয় আর শীতে বাংলাদেশকে দেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে না।
আদানির কেন্দ্রটি ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার। চুক্তি অনুযায়ী এই কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। বাংলাদেশ যদি কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হবে, তার পুরোটার দাম বাংলাদেশ আদানিকে দেবে।
পটুয়াখালীর পায়রায় স্থাপিত সরকারি প্রতিষ্ঠান আরপিসিএল ও নরেনকোর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৯৩ দশমিক ৪৮ গ্রাম কয়লার দাম পাবে। অথচ একই পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য আদানি পাবে ৫৫৫ দশমিক ৪৩ গ্রাম কয়লা। এতে বাড়তি কয়লার দাম বাবদ বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে যাবে আদানি।
অসম চুক্তির কারণে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেশি দেওয়া হয়েছে আদানিকে। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের মধ্যে চারটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো- পরিবর্তনশীল কেন্দ্র ভাড়া, স্থির কেন্দ্র ভাড়া, ইউএস সিপি ইনডেক্স (যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার) ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ। আদানির বিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্টই পড়বে প্রায় ৬ সেন্ট, যা দেশীয় মুদ্রায় ৭ টাকা ২০ পয়সা। সে হিসাবে বছরে আদানি শুধু কেন্দ্র ভাড়াই নেবে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের গ্যাসভিত্তিক ও তেলভিত্তিক বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেম লস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ১ লাখ টন কয়লা পরিবহণের সময় ১ হাজার ১০০ টন নষ্ট হয়ে গেছে দাবি করে তার দাম নিতে পারবে আদানি। পায়রায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও রামপাল কেন্দ্রে সিস্টেম লসের বিধান রাখা হয়নি।
আদানি ভারতেই কয়লার দামে মিথ্যাচার করে : বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয়কে বলা হয় পাস-থ্রু। এর মানে হলো বাজারে কয়লা, গ্যাস বা তেলের দাম যত, ঠিক ততটুকুই বিল হিসাবে ক্রেতার কাছে দাবি করতে পারে। আদানির নিজস্ব কয়লাখনি রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ায়। তারা কয়লার দাম সব সময় বাজারের চেয়ে বেশি দেখায়।
পিডিবির একাধিক প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, ভারতের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ (ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স বা ডিআরআই) ২০১৬-এর জুলাইয়ে দেশটির সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে বলা হয়, কয়লা আমদানিকারকরা আমদানির ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বেশি দাম দেখিয়েছে। এ অর্থ তারা পাচার করেছে।
ঝুঁকি জেনেও বিদ্যুৎ বিভাগের সায় : বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎ কিনতে সরকার ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) শেখ ফয়েজুল আমীনকে সদস্য সচিব করে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেশি বলে মত দেয়। এরপরও কমিটি ২৫ বছর মেয়াদে আদানির বিদ্যুৎ কেনার সুপারিশ করে। তবে এ চুক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের আওতায় করার পরামর্শ দেওয়া হয় কমিটির পক্ষ থেকে। এই আইন অনুযায়ী, আদানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে দেশের কোনো আদালতে যাওয়া যাবে না। এ সময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নসরুল হামিদ। তিনি এখন পলাতক। সে সময় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ছিলেন আহমেদ কায়কাউস। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে। পিডিবির সঙ্গে আদানির চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর। তখন পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ। তিনিও পলাতক।