তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ ট্রেনে হামলা-ভাঙচুর
শিশুসহ অর্ধশত ট্রেনযাত্রী আহত, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটে ভোগান্তি * রাতেও কলেজের সামনের সড়কে বিক্ষোভ, সচিবালয়ে অনশনে ১৪ শিক্ষার্থী
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ তিনদফা দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে সোমবার দিনভর আন্দোলন করেছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। এতে মহাখালী থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশেই সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতেও।
এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা। অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা হন। আন্দোলন চলাকালে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তঃনগর ট্রেন ‘উপকূল এক্সপ্রেস’ মহাখালীতে পৌঁছলে চলন্ত ট্রেনে আন্দোলনকারীরা হামলা-ভাঙচুর চালায়। এতে শিশুসহ অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। পরে সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। বিকাল ৪টার দিকে অবরোধ তুলে নিয়ে শিক্ষার্থীরা কলেজে ফিরে গেলে যানচলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
একই সময় শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রওয়ানা হন। তবে বৈঠকে দাবি পূরণের আশ্বাস না পাওয়ায় রাতেই সচিবালয়ে অনশনে বসেন ১৪ শিক্ষার্থী।
একই সময় তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করে ফের বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেখানে বিক্ষোভ চলছিল বলে জানান বনানী থানার ওসি। আন্দোলনকারীদের পক্ষে কলেজের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, আজও তাদের আন্দোলন চলবে। পাশাপাশি কলেজের সব পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ থাকবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সরোয়ার যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল ৪টায় তারা সড়ক ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে শিক্ষার্থীরা আবারও সড়ক অবরোধ করেন।
জানা গেছে, তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে সাত কলেজ থেকে তিতুমীর কলেজকে পৃথক (আলাদা) করতে হবে। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করতে হবে। এই কলেজকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
এসব দাবিতে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে সকাল থেকে কলেজে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করেন তারা। মিছিলটি আমতলী মোড় হয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহাখালী লেভেলক্রসিংয়ে যায়। সেখানে শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন।
বিকাল ৩টার দিকে কয়েক দফায় শিক্ষার্থীদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। অনুরোধ করেন তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষও। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অনড় থাকেন। পরে বিকাল ৪টার দিকে মিছিল নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে যায় তারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, মহাখালী রেলগেট ও আমতলী মোড়ে বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, দাবি বহুদিনের হলেও কর্ণপাত করেনি কেউ। এর প্রতিবাদেই তাদের অবস্থান কর্মসূচি।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, তিতুমীরকে সাত কলেজের সঙ্গে দেখতে চাই না, সেন্ট্রাল কোনো অধিভুক্তিতে দেখতে চাই না। আমরা এটাকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে দেখতে চাই।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, গত ২৭ বছর ধরে তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা। তবে কোনো সরকারই এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। বৈঠক করতে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে দাবি পূরণের আশ্বাস না পাওয়ায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা সচিবালয়ের করিডোরে বসে অনশন শুরু করেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে একই সময় মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করে আবারও বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা ‘এক, দুই, তিন চার, সব শালারা বাটপাড়’, ‘টিসি না টিইউ, টিইউ টিইউ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। অবরোধ ও বিক্ষোভে ব্যস্ত সড়ক মহাখালী আমতলী মোড় থেকে গুলশান-১ অভিমুখী রাস্তার দুই পাশেই সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে আশপাশের সড়কে আটকে থাকা যাত্রীরা আবারও ভোগান্তিতে পড়েন।
শিক্ষার্থী আজাহার উদ্দিন বলেন, আমরা শুনেছি, আমাদের প্রতিনিধিরা যে দাবি জানিয়েছিলেন, সেটা শিক্ষা উপদেষ্টা মেনে নিয়েছিলেন। তিন দিনের মধ্যে কমিশন করে দেবেন বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। পরে কিছু কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তারা দ্বিমত জানানোয় বিষয়টি আটকে গেছে। এজন্য আমরা আবারও রাস্তায় এসে বিক্ষোভ করছি। দাবি না মানা পর্যন্ত এ বিক্ষোভ চলবে।
রাতে সচিবালয়ে সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার পর বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে একটি কমিটি গঠন করার জন্য প্রেস রিলিজ তৈরি করা হয়। পরে কোনো একজন ব্যক্তির ফোনে ওই প্রেস রিলিজ জারি করা হয়নি। তিনি বলেন, কাজেই আন্দোলন ছাড়া শিক্ষার্থীদের যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। আমরা একটি যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।
দিনভর সড়কে তীব্র ভোগান্তি : অবরোধের ফলে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের যান চলাচল। আন্দোলনকারীরা মহাখালী রেলগেট এলাকার রেলপথের পাশাপাশি বিমানবন্দর সড়কের ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অংশও অবরোধ করেছিলেন। মহাখালী থেকে বনানী যেতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়সংলগ্ন ইউটার্ন এলাকায়ও তারা অবস্থান নিয়েছিলেন। এ ছাড়া মহাখালী থেকে গুলশান যাওয়ার সড়ক এবং মহাখালী উড়াল সড়ক হয়ে চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় নামার অংশের সড়কও তারা অবরোধ করেন। এসব সড়কের বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। কেউ কেউ হেঁটে গন্তব্যের পথে রওনা হন। তাদের কারও কারও হাতে মালপত্রের ভারী বস্তা, ব্যাগ দেখা গেছে। কেউ কেউ আবার সঙ্গে থাকা বয়স্ক স্বজনদের ধরে ধরে কিংবা শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে হেঁটে যান।
এ সময় সাধারণ মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তাদের ভাষ্য, দাবি যৌক্তিক হলে সরকারের কাছে গিয়ে তা পেশ করুক শিক্ষার্থীরা। রাস্তাঘাট বন্ধ করে, মানুষকে জিম্মি করে কষ্ট দিচ্ছে কেন। সুমি আক্তর নামে এক পথচারী বলেন, নাবিস্কো থেকে হেঁটে এসেছি মহাখালী পর্যন্ত। যাব টঙ্গিতে। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া খুবই কঠিন। পা ব্যথা হয়ে গেছে।
ট্রেনে হামলায় আহত অর্ধশত ও শিডিউল বিপর্যয় : এদিকে রেললাইন অবরোধ করায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়। দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। বিভিন্ন স্টেশন, আউটারে আটকটা পড়ে ট্রেন। এতে ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তঃনগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ে শিক্ষার্থীরা। এতে অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন বলে জানান স্থানীয়রা। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ট্রেনের সবকটি জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। জানালার পাশে যারা ছিলেন সবাই কমবেশি আহত হয়েছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে, দুপুরের পর থেকে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার মো, আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, শিক্ষার্থীদের অবরোধে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে পড়ে মহাখালীতে। ওই সময় শিক্ষার্থীরা ট্রেনটিতে লাগাতার ঢিল ছুড়ে। এতে ট্রেনের ভেতরে থাকা বেশ কয়েকজন যাত্রী রক্তাক্ত হন। ট্রেনেরও ক্ষতি হয়েছে। প্রায় অর্ধশতাধিক জানালার গ্লাস ভেঙে গেছে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনায় ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলা কমিউটার ট্রেনটি কমলাপুর থেকে না চালিয়ে টঙ্গী থেকে রাজশাহী রুটে বিকালে চালানো হয়েছে। এছাড়া মহাখালী ট্রেন অবরোধ ও ভাঙচুরের কারণে অগ্নিবীণা, মোহনগঞ্জ, বনলতা, কালনী, সিল্কসিটি, ব্রহ্মপুত্র উপকূল এক্সপ্রেসসহ আরও অন্তত পাঁচটি লোকাল ও কমিউটার ট্রেন ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিলস্বে চলাচল করে। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে কমলাপুর, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।