বেক্সিমকো গ্রুপের ফের ঋণ নেওয়ার চেষ্টা
আটকে দিলেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের নগদ ঋণসহ ফান্ডেড এবং নন-ফান্ডেড সুবিধার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। কর্মচারীদের অক্টোবর মাসের বেতন পরিশোধের জন্য সম্প্রতি সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠানটি ৬০ কোটি টাকার ঋণসহ নতুন করে ফান্ডেড (ব্যাংক থেকে নগদ ঋণ) ও নন-ফান্ডে (এলসির মাধ্যমে দায়) সুবিধা চেয়েছে।
এর আগে অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানের পরও এ গ্রুপের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্ট মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধে জনতা ব্যাংক ৫৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইনে একজন খেলাপি গ্রাহক নতুন ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সর্বশেষ হিসাবে গত আগস্ট পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপ (২৮টি প্রতিষ্ঠান) জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকাই খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ গ্রহণকৃত মোট ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশই খেলাপি। পাশাপাশি ওভারডিউ ঋণের অঙ্ক প্রায় তিন হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা।
ঋণ আটকে দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সোমবার জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহ. ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, দেখা যাক, এখন সবার সহযোগিতা পেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে। নতুন ঋণ সুবিধা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দিয়েছেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহ. ফজলুর রহমান।
সেখানে তিনি বলেন, ‘শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে আলোচ্য গ্রাহককে (বেক্সিমকো গ্রুপ) নতুনভাবে ঋণ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন হলে, যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য ও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা আছে তাদের মাধ্যমেই ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা যুক্তিযুক্ত হবে। এ ধরনের গ্রাহককে (বেক্সিমকো) নতুন করে ঋণ দেওয়া হলে বিদ্যমান সংকট থেকে জনতা ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ না দেওয়ার বিধান রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ২৭কক ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কোনো খেলাপি ঋণ গ্রহীতার অনুকূলে ঋণ সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একই আইনের ২৬খ ধারা অনুযায়ী কোনো একক গ্রাহকের অনুকূলে ব্যাংকের রক্ষিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই।
অথচ একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী বেক্সিমকো গ্রুপকে ব্যাংকের মোট রক্ষিত মূলধনের ৪১০ শতাংশ ঋণ দেয় জনতা ব্যাংকের বিগত কর্তৃপক্ষ। গত কয়েক বছর ঋণ দেওয়া অব্যাহত ছিল বলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয় অর্থ উপদেষ্টাকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এখানে ব্যাংক কোম্পানির আইনের কিছুই মানা হয়নি। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার সময় জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি অর্থ সচিব থেকে গভর্নর থাকা পর্যন্ত পুরোটা সময় আব্দুছ ছালাম আজাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি গ্রাহক নতুন ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। যে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে সেটি ঠিক করতে হবে পুনঃতফসিল বা পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে। বেক্সিমকো গ্রুপ খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে যদি বের না হয় তবে বর্তমান ব্যাংক আইন অনুযায়ী তাদের ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়।
আর জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে নানাভাবে টাকা বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেক্সিমকোর ইতিহাসও আছে। ফলে সক্ষমতা থাকলেও ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না।
অর্থ উপদেষ্টাকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, গত ছয় মাস থেকে দুই বছর মেয়াদে বেক্সিমকো গ্রুপের রপ্তানিমূল্য অপ্রত্যাবাসিত রয়েছে এক হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রদত্ত প্যাকিং ক্রেডিট ও বিসিএলসির দায় এখন পরিশোধ করা হয়নি। এই ব্যাংকের নট্রো অ্যাকাউন্ট বিকলন করা হলেও ইডিএফ দায় বাবদ ৫৬৪ কোটি টাকাও বকেয়া আছে, যা গ্রাহক কর্তৃক পরিশোধ করা হয়নি।
সেখানে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্য ৬০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হলেও গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৯০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসিত হয়েছে। এই অর্থ থেকে গ্রাহক ইতোমধ্যে প্যাকিং ক্রেডিট বাবদ ১৫ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ বিবিএলসি বাবদ ৮১.৫৮ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণ করেছে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খেলাপির সঙ্গে সমন্বয় হবে।
সূত্রমতে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শুধু জনতা ব্যাংক থেকেই ঋণের নামে টাকা বের করে নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এসব ঋণের অধিকাংশই ছিল বেনামি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে বেনামি ঋণগুলো তার নামে সংযুক্ত করেছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে নেওয়া।
আগের দায় পরিশোধ না করে বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধের জন্য ঋণ আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। সে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে খেলাপি ঋণ প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ৫৫ কোটি টাকা ঋণ ইস্যু করা হয়। যা কোনো এলসির বিপরীতে দেওয়া হয়নি।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, বারবার নিয়ম ভেঙে ঋণ না দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে গিয়ে জনতা ব্যাংক নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
এদিকে অক্টোবর মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুর মহানগরীর সারাবো এলাকায় তৃতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা। সোমবার সকাল ৯টা থেকে চন্দ্রা-নবীনগর সড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন তারা। এতে দুর্ভোগে পড়েন ওই সড়কে চলাচলকারীরা। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের আশপাশের ২০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
সড়কটিতে বিক্ষোভের কারণে বেশ অসুবিধায় পড়েছেন যাত্রী ও চালকরা। তাদের অনেকেই নানা প্রয়োজনে বিকল্প উপায়ে আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বেতনের দাবিতে গত শনিবার থেকে তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।