Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব

গ্রামে ঋণপ্রবাহে ধস

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গ্রামে ঋণপ্রবাহে ধস

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গ্রামের ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে। গ্রামে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে বলতে গেলে ধস নেমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এ খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত জুলাই-আগস্টে কমেছিল সর্বোচ্চ ৩০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পাশাপাশি গ্রামে আমানত প্রবাহও কমেছে।

দেশের সার্বিক অর্থনীতির হালনাগাদ চিত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এ প্ররিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ঋণ বিতরণের আগের কাঠামো অনেকটা ভেঙে পড়েছে। আগে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেন তাদের বেশির ভাগই ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে অনেক উদ্যোক্তা নতুন ঋণ নিয়ে কিছু করছেন না। আবার ব্যাংকগুলোও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন ঋণ দিতে চাচ্ছেন না। এসব মিলে গ্রামে ঋণপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। তবে অক্টোবরে গ্রামে ঋণ ও আমানত প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে এখন থেকে গ্রামে টাকার জোগান বাড়বে। সরকার পতনের পর বড় ধরনের অস্থিরতার প্রভাব এখন ধীরে ধীরে কাটছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামে এখনই ঋণের চাহিদা বেশি হওয়ার কথা। কারণ বোরো চাষের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। শীতের সবজি বাজারে এসে গেছে। শীতকে কেন্দ্র করেই গ্রামের সব আবাদি জমিতে চাষ হয়। এছাড়া গত জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিন দফা বন্যা হয়েছে। এতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গ্রামে এখন ঋণের চাহিদা বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে উলটোটি। ঋণের চাহিদা যেমন কমেছে, তেমনি ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণও কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এ দুই খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই দুই খাতে গ্রামে গড়ে ঋণ প্রবাহ কমেছিল ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৩৮ দশমিক ২২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কৃষিঋণ বিতরণ না বেড়ে বরং কমেছে ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে ঋণ আদায় বেড়েছিল ২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। একইভাবে গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঋণের প্রবাহ বেড়েছিল ৩৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে না বেড়ে বরং কমেছে ৩৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় বেড়েছিল ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে না বেড়ে বরং কমেছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

গত অর্থবছরের ওই সময়ে দুই খাতে গড়ে গ্রামে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৩৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আলোচ্য দুটি খাতে গড়ে ঋণপ্রবাহ না বেড়ে কমেছে ৩০ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণের প্রবাহ গড়ে বেড়েছিল ৫৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পরপর দুই অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্রামে ওই দুই খাতে ঋণের প্রবাহ বড় অঙ্কের লাফ দেওয়ার পর চলতি অর্থবছরের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় গ্রামে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা বেশি।

২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রামে ঋণপ্রবাহ কমেছিল ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে আবার বেড়েছিল ৬৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমেছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। প্রাপ্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের আলোচ্য সময়েই গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণপ্রবাহ কমেছে গ্রামে।

গত বছরের জুনে গ্রামে আমানতের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। তবে গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে গ্রামে আমানত প্রবাহ বাড়ছে। তবে এখনো তা গত বছরের জুনের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। গত সেপ্টেম্বরে গ্রামে আমানত কমে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায়। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা হয়। এ বছরের মার্চে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। জুনে তা আরও বেড়ে হয় ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে গ্রামে আমানতের স্থিতি ৭৬ হাজার কোটি টাকা কম। গত বছরের জুনে মোট আমানতের ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ ছিল গ্রামে। এখন তা ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। আলোচ্য সময়ে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ১৬ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৮ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে গ্রামে আমানত না বেড়ে বরং কমেছে। শহরে আমানত বেড়েছে।

বিভিন্ন সংস্থার জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি ও মানুষের আয় কমার কারণে গ্রামের মানুষের সঞ্চয় কমেছে। তারা সঞ্চয় ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেছে।

গত বছরের জুনে গ্রামে ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকায়। গত বছরের জুনে মোট ঋণের মধ্যে গ্রামের ঋণের অংশ ছিল ১২ দশমিক ০২ শতাংশ। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে এজেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসার গ্রামে হচ্ছে বেশি। ফলে এর মাধ্যমে গ্রামে ঋণ ও আমানত দুটিই বেড়েছে।

এদিকে দেশের ব্যাংকগুলোর মোট শাখার সংখ্যা বাড়লেও গ্রামীণ শাখা কমেছে। গত আগস্টে মোট শাখা ছিল ১১ হাজার ৩২১টি। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩২৩টি। শাখা বেড়েছে ২টি। আগস্টে গ্রামীণ শাখা ছিল ৫ হাজার ২৭৩টি। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৫৮টি। শাখা কমেছে ১৫টি।

এটিএম বুথ ও পয়েন্ট অব সেলস কমেছে। আগস্টে এটিএম বুথ ছিল ৩ হাজার ৮৭৬টি। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৬১টিতে।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর সূত্র জানায়, গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পৌরসভায় রূপান্তরিত হচ্ছে। পৌরসভার শাখাকে গ্রামীণ শাখা হিসাবে গণ্য করা হয় না। শহরে শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া কিছু লোকসানি শাখা গ্রাম থেকে সরিয়ে পাশের কোনো পৌরসভার মধ্যে স্থানান্তর করার কারণেও এমনই হচ্ছে। তবে গ্রামে কোনো শাখা বন্ধ করা হচ্ছে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম