বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের ভাষণে ড. ইউনূস
বিপর্যয় থেকে পৃথিবী রক্ষায় নতুন জীবনধারা জরুরি
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা ঢেলে সাজানোর আহ্বান * স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে অবিচারের শিকার -জাতিসংঘ মহাসচিব
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় নতুন জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে। এই জীবনধারার ভিত্তি হবে ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন নিসরণ’। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বুধবার ‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৯)’ উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘তিন শূন্যভিত্তিক একটি নতুন পৃথিবী গড়ার ধারণা তুলে ধরেন। এ সময় সামাজিক বাণিজ্য গ্রুপের এক বৈঠকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নতুনভাবে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সম্মেলনের সাইড লাইনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বড় অবিচারের সম্মুখীন হয়েছে।
ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের আরেকটি পালটা সংস্কৃতি গড়তে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যরে ওপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্যপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে, কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।’ অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই জীবনযাত্রাও হবে শূন্য কার্বনের ওপর ভিত্তি করে। যেখানে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না, শুধু পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি থাকবে। এতে এমন একটি অর্থনীতি হবে যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক ব্যবসার মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে শূন্য মুনাফার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা’ সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে একটি নন-ডিভিডেন্ট (মুনাফা নেওয়া যাবে না) ব্যবসা। এর একটি বিশাল অংশ পরিবেশ ও মানবজাতির সুরক্ষায় মনোযোগ দেবে। সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন কেবল সুরক্ষিতই হবে না, গুণগতভাবে উন্নত হবে। এটি যুবকদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজতর করবে। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন শিক্ষার মাধ্যমে তরুণরা প্রস্তুত হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চাকরিপ্রার্থী তৈরির শিক্ষা উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’ পরিবেশের সুরক্ষায় একটি নতুন জীবনধারার প্রয়োজন। তার মতে, নতুন জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ হিসাবে বেছে নেবে। প্রতিটি যুবক তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসাবে বেড়ে উঠবে। এগুলো হচ্ছে-শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শুধু সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব।
ড. ইউনূস বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসাবে বেড়ে উঠবে এবং সারাজীবন তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসাবে থাকবে। এটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের যা করতে হবে তা হলো এ গ্রহের নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করা যেখানে সবাই বসবাস করে। আজকের তরুণ প্রজন্ম বাকিটা করবে।’ অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আশা করি আপনারা এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমরা একসঙ্গে স্বপ্ন দেখলে তা সম্ভব।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে। সে কারণে মানবসভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে। মানুষ আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক, আর্থিক ও যুব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আত্মরক্ষাত্মক ও আত্মশক্তিবর্ধক একটি নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করতে হবে।’ তার মতে, এই গ্রহের মানব বাসিন্দারাই গ্রহ ধ্বংসের কারণ। মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করছে। তারা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছে, যা পরিবেশের প্রতিকূলে কাজ করে। তারা এটিকে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে ন্যায্যতা দিচ্ছে। যাকে এই সৌরজগতের মতোই প্রাকৃতিক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এই অর্থনৈতিক কাঠামোটি সীমাহীন ভোগের ওপর ভিত্তি করে চলছে। যত বেশি ভোগ, তত বেশি প্রবৃদ্ধি। আর যত বেশি প্রবৃদ্ধি, তত বেশি অর্থ। মুনাফা সর্বাধিকীকরণ সিস্টেমের সবকিছুকে আমাদের ইচ্ছামাফিক কাজ করানোর কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক : সম্মেলনের সাইড লাইনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। রূদ্ধদ্বার এই বৈঠকে বাংলাদেশ ছাড়া আরও ৪টি প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এগুলো হলো-নেপাল, মালাউই, গাম্বিয়া ও লাইবেরিয়া। বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, পৃথিবী হতে হবে মানুষের জন্য কল্যাণকর।’ এ সময়ে বিশ্বের তরুণদের জন্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত ‘সামিট ফর দ্য ফিউচার’ সম্মেলনের প্রতিও সমর্থন জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলন করা উচিত নয়। কারণ প্রতিবছর আলোচনার জন্য মিটিং করা সময়সাপেক্ষ, অপচয় এবং অপমানজনক।’ বিশ্বের কী প্রয়োজন, তা আমরা জানি। এজন্য আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা উচিত। এটি হতে হবে দেশভিত্তিক। জলবায়ু আলোচনার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির আহ্বান জানিয়ে বলেন, বর্তমান পদ্ধতিটি বিশ্বের বেশির ভাগ চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বড় অবিচারের সম্মুখীন হয়েছে।