পঞ্চদশ সংশোধনী রুলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল
শেখ মুজিব জাতির পিতা মূল সংবিধানের চেতনা পরিপন্থি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংবিধান থেকে জাতির পিতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বুধবার পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে জারি করা রুলের শুনানিতে একথা বলেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে এই শুনানি হয়। শুনানিতে তিনি বলেন, শেখ মুজিবের অবদানকে কেউ অস্বীকার করে না, কিন্তু তাকে জাতির পিতা বলা মূল সংবিধানের কনসেপ্টের পরিপন্থি।
শুনানিতে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। মৌলিক অধিকার ধ্বংস করা হয়েছে। সংবিধানের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি’ বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ আইন কর্মকর্তা বলেন, এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে ভাষা দিয়ে জাতিসত্তা নির্ধারণ হয় না।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এটা নয় যে হাজার হাজার মানুষকে গুম করা হবে, ৬০ লাখের বেশি মানুষকে গায়েবি মামলার আসামি করা হবে, বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হবে। যাদের হাত নেই এরকম মানুষকে আসামি করে বলা হবে তারা বোমা মেরেছেন। হজে থাকা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এসব হতে পারে না।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র না। আমরা সমাজতন্ত্র বাদ চাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে কেউ অস্বীকার করে না। জাতির পিতা নিয়ে সিরিয়াস বিতর্ক আছে। জাতি বিভক্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৈরি করা সংবিধানে জাতির পিতা ছিল না। এটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে ঢুকানো হয়েছে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন করা হয়েছে তার (শেখ মুজিব) বিরুদ্ধে কথা বললেই রাষ্ট্রদ্রোহ হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ বাতিল চাচ্ছি। এটার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে ভাষা দিয়ে জাতিসত্তা নির্ধারণ করা হয় না। ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য করা হয়েছে। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি। অনুচ্ছেদের ৮-এর বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা রাখার দরকার নেই। এই দেশের ৯০ ভাগ মুসলমান। আগে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ছিল। এটা যেভাবে আগে ছিল সেভাবে চাচ্ছি। আর ২ক তেই বলা আছে সব ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমান অধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করবে। অনুচ্ছেদ ৯-এ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে। এটি সাংঘর্ষিক।
অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে, মৌলিক অধিকার ধ্বংস করা হয়েছে। কেন পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না? এটা সংবিধানের অংশ হিসাবে রাখা যাবে না। পঞ্চদশ সংশোধনী রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ৯০-এর গণঅভুত্থ্যান ও ২৪-এর জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল না হলে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে না।
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে রুলকে সাপোর্ট করি। তবে পুরো পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চাই না। কয়েকটা জায়গা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধংস করা, ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করা, সংবিধানের সুপ্রিমেসি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটা সংবিধানের ওপর প্রতারণার শামিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলটা গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। রায়ের জন্যও অপেক্ষা করেনি। ১২৩ অনুচ্ছেদে সংসদ-সদস্য বহাল রেখে আবার নির্বাচন করা অবৈধ। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করে।
সংবিধানে জাতির পিতার বিষয়ে তিনি বলেন, জাতির পিতার প্রশ্নে বলেছি, এখানেও আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার অবদান অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে উনি অনেক উপরের মানুষ। কিন্তু একজন ব্যক্তি সবকিছু করেছেন-এটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উই দ্য পিপল অব বাংলাদেশ। আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি। এই কথা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন। ‘উইনেস’ থেকে সরে এসে আমরা ‘আইনেস’ এবং বায়োপিক থিউরিতে গেছি। এটা আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে যে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত না। আমাদের দেশ রাষ্ট্র সমাজকে ধংস করে দিচ্ছে। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ এবং সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত অনুচ্ছে ৭ ক ও খ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গণতন্ত্রকে হত্যা, সংকুচিত ও নির্বাসিত করার জন্য এই ৭ ক ও খ করা হয়েছে। গণভোট নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে জনগণের কথা বলার অধিকার আছে। তারা এ বিষয়ে গণভোটে মত জানাতে পারেন। কিন্তু গত সরকার গণভোটের বিধান বিলোপ করে জনগণের কণ্ঠরোধ করেছে।
২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। পরে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। সুজন সম্পাদক বদিউল আলমসহ ৫ ব্যক্তি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) তিনটি আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। ১৭ নভেম্বর এর ওপর শুনানির তারিখ রয়েছে। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসাবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম প্রমুখ। সেই রুলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে।