কপ২৯ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা
জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সহায়তা প্রয়োজন
বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক * অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস
বাসস
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সীমিত ডিকার্বনাইজেশন সক্ষমতা সম্পন্ন বেশির ভাগ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সবুজ শিল্প বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা মঙ্গলবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ২৯ সম্মেলনে জার্মানি ও চিলি আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের জলবায়ু ক্লাব নেতাদের সভায় বত্তৃদ্ধতাকালে এ কথা বলেন। এর আগে বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) সাইডলাইনে মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে বিশ্বনেতারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসার পাশাপাশি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
কপ২৯ সম্মেলনে ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও রেয়াতি ডিকার্বনাইজেশন ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে ক্লাইমেট ক্লাবের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন আরও বেশি দ্রুত ও টেকসই উপায়ে হ্রাস এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্যে পৌঁছানোর জন্য উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বিশেষ করে উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রমাণিত কম নির্গমন প্রযুক্তি প্রদর্শন ও স্থাপন করার আহ্বান জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ডিকার্বনাইজেশন প্রযুক্তির জন্য উল্লেযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগের প্রয়োজন। অর্থায়নের সীমিত সুযোগ রয়েছে এমন দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের অধিক মূলধন বিনিয়োগ করা শিল্পের জন্য একটি বাধা হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের শিল্পের জন্য রেয়াতি অর্থের সুযোগ লাভকে উৎসাহিত করে শিল্প ডিকার্বনাইজেশনের ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য আর্থিক ব্যবস্থার বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬.৮-এর অধীনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, অতএব, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও উন্নয়ন চাহিদার কারণে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খণ্ডিত উপায়ে উচ্চাভিলাষী প্রশমন নীতিগুলো শিল্প কর্মকাণ্ডকে এমন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে কার্বন মূল্যের কোনো নীতি নেই বা কম কঠোর, যা কার্বন নির্গমনের দিকে ধাবিত করে এবং এভাবে সামগ্রিক বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন হ্রাসের বৈশ্বিক লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তনকে সমর্থন করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ও উদীয়মান বাজারে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, ঘানার রাষ্ট্রপতি নানা আকুফো-আড্ডো, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ্জু, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাষ্ট্রপতি ডেনিস বেচিরোভিচ, বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইদি রামা, লিচেনস্টাইনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েল রিশ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে ও ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিনা আনসারি। এছাড়াও মিসরের মর্যাদাবান আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড ইমাম ড. আহমেদ আল তাইয়েব এবং ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে সাক্ষাৎকার করেন তিনি। এ সময় নেতারা জলবায়ু সংকট সমাধানের উপায় এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বাসসকে বলেন, ‘জলবায়ু সম্মেলনের সাইডলাইনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও আরব-আমিরাতে প্রেসিডেন্টসহ ২০ জন বিশ্বনেতা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানান।’
অপূর্ব জাহাঙ্গীর আরও বলেন, সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অধ্যাপক ইউনূসকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। অধ্যাপক ইউনূস তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। ছাত্র আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিককে মুক্তি দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা আরব-আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে ধন্যবাদ জানান। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আল আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম ড. আহমেদ আল তাইয়েব বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে এবং উন্নতি করবে। এ সময় অধ্যাপক ইউনূসকে হাজার বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান ড. আহমেদ আল তাইয়েব। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ফুল ফান্ডেন্ড স্কলারশিপ ঘোষণা করবে বলেও জানান তিনি। গ্র্যান্ড ইমাম বলেন, ‘আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। আপনি একজন বিচক্ষণ মানুষ। বিপ্লবের পর বাংলাদেশ নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। আমি আপনাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করার জন্য স্যালুট জানাই।’ অধ্যাপক ইউনূস গ্র্যান্ড ইমামকে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ সশরীরে ঘুরে দেখার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো জানুয়ারিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় যুব উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক ইউনূস ফিফা প্রধানকে উৎসব সম্পর্কে অবহিত করেন এবং স্বনামধন্য মহিলা ফুটবল দলকে বাংলাদেশে আনতে তার সহায়তা কামনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বর্তমানে ৪ দিনের সরকারি সফরে বাকুতে অবস্থান করছেন। সোমবার আজারবাইজানের স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বাকু পৌঁছেন। তিনি কপ২৯ সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবেন এবং সাইডলাইনে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন। সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত।