নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি
পদক্ষেপের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে
গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯.৯২ শতাংশেই লাগাম টানতে পণ্যের শুল্ক কমানোসহ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয় সরকার সেপ্টেম্বরে। একই সঙ্গে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু এরপরও লাগাম পড়েনি মূল্যস্ফীতিতে। পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের পর উলটো বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশে উঠেছে। প্রয়োজনের তুলনায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বেশি না কম গ্রহণ করা হয়েছিল, সে প্রশ্ন সামনে আসছে। ফলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপগুলো। অপরদিকে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও পর্যালোচনা চলছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক ডলারের মূল্য এখন স্থিতিশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্য, গ্যাসসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম কমছে। এতে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এরপরও লাগাম টানা যাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির গড় হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল ২০২১ সালে, তা বেড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উঠে ২০২২ সালে। এরপর কমে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আসে ২০২৩ সালে এবং চলতি বছরে সেটি আরও হ্রাস পেয়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এর উলটো চিত্র বিরাজ করছে। গত বছরে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ থাকলেও চলতি অক্টোবরে বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বিরাজ করছে।
যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ অর্থনীতি খাতে নীতিনির্ধারক মহল সেপ্টেম্বরে এক বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ওই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল দ্রব্যমূল্য কমাতে কোন কোন পণ্যের আমদানি শুল্ক যৌক্তিক্করণ করতে ট্যারিফ কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পর্যালোচনা করবে। বিশেষ করে ভর্তুকি দেওয়া পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানোর বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও অর্থ বিভাগের রাজস্ব নীতি অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও সার আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ নিশ্চিত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সার সরবরাহ নিশ্চিত, ভর্তুকির চাপ কমাতে সার উৎপাদন বাড়ানো এবং সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে সক্রিয়ভাবে বাজার মনিটরিং, ডিলার ও মিল মালিকদের পণ্য সরবরাহে উৎসাহিত করা, সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরাও ভূমিকা নেবেন বলে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন নীতি-নির্ধারকরা। এছাড়া পণ্যের অবৈধ মজুত ঠেকাতে গুদামগুলোয় নজরদারি, কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়।
অবশ্য পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। পদক্ষেপের অংশ হিসাবে চালের ওপর দুই দফায় ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে শূন্য শতাংশ করা হয়। এছাড়া চিনির ওপর ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোজ্যতেলে ১০ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১০ থেকে ৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বাকি ৫ শতাংশও প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ পণ্যের দাম কমেনি শুল্ক তুলে নেওয়ার পরও।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে বৈঠক করে যখন এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ওই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের পর অক্টোবরে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠেছে মূল্যস্ফীতি, যা আশাহত করে নীতিনির্ধারণী মহলকে। প্রশ্ন ওঠে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনার। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার অর্থ উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বৈঠকও করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বৈঠক শেষে একটি বিষয়ে জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচন মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। তবে এ পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না কম হলো, সেটি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক গ্রহণের পরও ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লেগেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আসতে। ইউকে, ইউএসএ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সর্বত্র মুদ্রানীতি সংকোচন করার ফলে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নেমে আসছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সেটি প্রমাণ হয়েছে বলে যুগান্তরকে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরী। এর সঙ্গে রাজস্বনীতি, বাজারব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাহিদা ও সরবরাহ উভয় সাইটে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য একটি সমন্বিত নীতি কাঠামো গ্রহণ করতে হবে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য সাইট থেকে একসঙ্গে আঘাত করতে হবে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথম হচ্ছে সাম্প্রতিক বন্যার প্রতিফলন। যে কারণে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া অন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। এর প্রতিফলন বাজারে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শেষটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতির সূচক এখন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না, সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, এখন সঠিক মূল্যস্ফীতির হার একটু বেশি হচ্ছে এ কারণে।
মূল্যস্ফীতির পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখে চালের মূল্য। দেশের প্রেক্ষাপটে এর মূল্য বেশি। শূন্য শুল্ক করার পরও কেউ আমদানি করছে না। ভারত থেকে আনতে গেলেও ট্রাক ভাড়া দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্য থেকেও ব্যয় বেশি হবে। ফলে চালের ডিউটি জিরো এবং আমদানিও জিরো অবস্থায় আছে। তাই মূল্যস্ফীতি শিগ্গিরই কমছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।