Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ঢাকা-যশোর ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ

লোকসানে বেসামাল বিশেষ দুই প্রকল্প

শিপন হাবীব

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোকসানে বেসামাল বিশেষ দুই প্রকল্প

ফাইল ছবি

লোকসান ও সেবাবঞ্চিতের ধাক্কায় বেসামাল শেখ হাসিনার ‘দুই উপহার’ ঢাকা-যশোর এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৫৭ হাজার ৫৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রকল্পের প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন দুটি রেলপথে প্রতিদিন ট্রেন চলবে অন্তত ৪৮ জোড়া বা ৯৬টি ট্রেন। কিন্তু বর্তমানে এ দুই পথে ট্রেন চলছে মাত্র ৫টি। অর্থাৎ আরও ৯১টি ট্রেন চলার গল্পটি এখনও কাগজে-কলমেই আটকে আছে। পাঁচটি ট্রেন চালাতে গিয়েই লোকসান গুনতে হচ্ছে বড় অংকের অর্থ। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলা হয়েছে রুট দুটি হবে সবচেয়ে লাভবান-যাত্রীবান্ধব। 

জানা গেছে, ঢাকা-যশোর পদ্মা রেললিংক ও চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেল রুট ইঞ্জিন-কোচের অভাবে থমকে আছে। এ দুই প্রকল্পেই ইঞ্জিনের প্রয়োজন প্রায় ৭৭টি এবং কোচের প্রয়োজন ২ হাজার ১১২টি। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই ইঞ্জিন এবং কোচগুলো কেনার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের গাফলতিতে তা করা হয়নি। রোলিংস্টক স্বল্পতার কারণে ওই পথে বর্তমানে মাত্র ৫টি ট্রেন চলাচল করছে। যা দিয়ে রেলের লোকসান কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রেল সূত্রের খবর, প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের আগে প্রাথমিক সমীক্ষাও যথাযথভাবে হয়নি। এখন এগুলো ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ১৭৯ কোটি এবং ঢাকা-যশোর প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটার ব্যয় প্রায় ২২৭ কোটি টাকা। ভারতসহ উন্নত দেশেও রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হয় ১২ কোটি থেকে ৭০ কোটি টাকার মধ্যে। বিশেষ এ দুটি প্রকল্পে এমন ভয়ংকর অনিয়ম-দুর্নীতির খবরে-মাঠে নেমেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তথ্য বলছে, ঢাকা-যশোর ৩০ বছর এবং দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পের অর্থনৈতিক রিটার্ন ধরা হয়েছে ১৭ বছর। বর্তমানে একেকটি ট্রেনে প্রতি মাসে গড়ে ১ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। অর্থাৎ ৫টি ট্রেনে মাসে ৫ কোটি টাকা আয়। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, ট্রেন ৩টি পরিচালনায় আয় ও সেবা তলানিতে। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো প্রকল্প নিজ থেকে বাস্তবায়নের কথা বলতেন তখন অন্যরা কেউ এ বিষয়ে কথা বলতেন না। অনেক সময় এমন প্রকল্পের প্রাথমিক সমীক্ষা বা তথ্য-উপাত্ত সঠিক কিনা, তাও দেখা হতো না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্প মানেই কেউ খরচের কিংবা আয়-ব্যয়ের কোনো প্রশ্নই তুলতেন না। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্পে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে। রেলের প্রকল্প দুটিতে অর্থনৈতিক রিটার্ন আসবে কিনা, সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কিনা-কেউ এ নিয়ে কথা বলেননি।’ ড. এম শামসুল হক বলেন, তৎকালীন ‘রেলমন্ত্রী-সচিব জানতেন, এ প্রকল্প জনগণ এবং দেশের জন্য যথাযথ নয়। কিন্তু, মন্ত্রী বলে বেড়াতেন, আয় বড় নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নই বড় কথা। তারা বলতেন ট্রেন চালিয়ে আমরা তো লাভ করতে বসিনি-আমরা তো জনগণকে সেবা দিতে বসেছি। কিন্তু এসব প্রকল্প এখন জনগণ এবং রাষ্ট্রের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে নতুন রেলপথ নির্মাণসহ সংস্কার কাজে। ওই সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১১৪টি ইঞ্জিন ও রোলিং স্টক ক্রয়ে খরচ করা হয়েছে মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে ১১৪টি ইঞ্জিন এবং ৫০০টি কোচ করা হয়। পরিকল্পনা দপ্তরের তথ্য, নতুন রেলপথে ট্রেন পরিচালনা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ পরিবর্তন করতে হলে গত ১৫ বছরে ইঞ্জিনের প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪০০ এবং কোচ সংগ্রহ করতে হতো প্রায় ৩ হাজার। রোলিং স্টক ক্রয়ে নজর দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। 

রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-যশোর রেলপথের একাংশ চালু হয় গত বছর। চলতি মাসের মধ্যেই পুরো রুটে ট্রেন চালু হবে। বর্তমানে এ রুটে তিন জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে। ইঞ্জিন-কোচ না থাকায় এ রুটে সহসাই আরও ট্রেন চালু হবে এমনটাও নয়। প্রকল্পের প্রস্তাব অনুযায়ী এ রুটে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫৫টি ট্রেন চলার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

এই রুটে চলা আন্তঃনগর ট্রেনের মাসিক আয়ের চিত্র যুগান্তরের হাতে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনের (৭৫৬) মাসিক আয় হয় ৭৭ লাখ ২০ হাজার ৩৪৭ টাকা। একই ট্রেনে চলতি বছরের আগস্টে আয় ৫৮ লাখ ১০ হাজার ১৪০ টাকা। কিন্তু, প্রতি মাসে ব্যয় ৯০ লাখ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে একটি ট্রেনেই শুধু জ্বালানি খাতে লোকসান হচ্ছে মাসে ১৩ লাখ টাকার বেশি। বছরে গিয়ে একটি ট্রেনে লোকসানের পরিমাণ বড় অঙ্কে দাঁড়াচ্ছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেসে ট্রেনের আয় ৫৪ লাখ ১৫ হাজার ৪৭৮ টাকা, আগস্টে আয় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ২১৮ টাকা। জুলাইয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেসের আয় ৭৬ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৪ টাকা এবং আগস্টের আয় ৫৮ লাখ ৯ হাজার ১৭৮ টাকা। প্রতিটি ট্রেনেই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে রেলে বাড়ছে লোকসান।

রেলে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় বিশেষ প্রকল্পটি দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পটির শুরুতে মাত্র ১৮শ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ১৮ হাজার কোটি টাকাতে নিয়েছিল। ২০১০ সালে নেওয়া এ প্রকল্প ঘিরে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড়ে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭৯ কোটি টাকা। এ রুটে ডিসেম্বরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ২টি ট্রেন চলাচল করছে। অথচ প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, এ রুট হবে সবচেয়ে লাভবান রুট। কক্সবাজারে যে পরিমাণ পর্যটক আসা-যাওয়া করেন-এর প্রায় অর্ধেক চলাচল করবেন ট্রেনে। এ রুট চালুর শুরু থেকেই অর্থাৎ প্রথম বছরেই যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনায় প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা আয় করবে। বর্তমানে মাসে একেকটি ট্রেনে আয় হচ্ছে সোয়া কোটি টাকার মতো। হিসাব অনুযায়ী ২টি ট্রেনে বছরে (বন্ধের দিন ধরে) আয় হবে ৩০ কোটি টাকা। 

দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন যুগান্তরকে বলেন, ‘এ রুট নিশ্চয় লাভবান হবে। এজন্য পর্যাপ্ত ট্রেনের প্রয়োজন। আমরা চেষ্টা করছি, এ রুটে যথাযথ ট্রেন পরিচালনা করতে। অর্থনৈতিক রিটার্নের সময় ধরা হয়েছে ১৭ বছর। প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী ঢাকা-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ট্রেন পরিচালনা করতে পারলে এ রুট সাড়া ফেলবে। এজন্য পর্যাপ্ত ট্রেন চালাতে হবে।’ 

পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ রুট চালুর পর থেকেই ২৪ জোড়া ট্রেন পরিচালনার কথা। অর্থাৎ প্রকল্প গ্রহণের সময়ই এ রুটে কি পরিমাণ ট্রেন চালনো যাবে, তা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, রেলপথমন্ত্রী, সচিব এবং সরকার ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে আগ্রহ কম দেখাতেন। রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি নজর ছিল তাদের। শুরুতে এ প্রকল্পটি দোহাজারী-কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত করার কথা ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ রেল যুক্ত হবে। কিন্তু, ওই অংশের কাজ বাতিল করা হয়েছে। 

রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেল ক্রমাগত লোকসানে চলছে। গত অর্থবছরে দুই হাজার আটশ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে নেওয়া দুটি বিশেষ প্রকল্প রেলের লোকসানকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এ রুটে ট্রেন চালিয়ে তেলসহ আনুষঙ্গিক খরচের টাকাই উঠছে না। ঠিক কী পদক্ষেপ নেওয়া হলে রেলের এই দশা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে, এ নিয়েও কোনো গবেষণা নেই। রেলের আয় এক জায়গায় আটকে পড়েছে। বছরের পর বছর লোকসানের খতিয়ান থেকে বেরিয়ে এসে কোন পথে লাভের মুখ দেখতে পারে-তা নিয়েও কোনো পরিকল্পনা নেই। 

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, নতুন রেলপথ নির্মাণ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। আমরা পুরো বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেলপথে কি পরিমাণ প্রকল্প গ্রহণ বাস্তবায়ন হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করা হবে। রেলপথ সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা হওয়ার কথা। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন হওয়ার কথা ট্রেন। কিন্তু, সবই যেন উলটো। আমরা যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। রেল হবে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ পথ। আয় বাড়িয়ে, সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য যা যা করণীয় তা করার চেষ্টা চলছে।’


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম