বিবিসির প্রতিবেদন
ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে সাত অগ্রাধিকার
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে নজিরবিহীন ক্ষমতা নিয়ে হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন করছেন। কারণ, মার্কিন পার্লামেন্ট কংগ্রেসের দুই কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটেও তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ট্রাম্প ইতোমধ্যে অভিবাসন, অর্থনীতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিজয়ী ভাষণে বুধবার ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি একটি সহজ মন্ত্রের মাধ্যমে শাসন পরিচালন করব। তা হলো-‘প্রতিশ্রুতি দেওয়া, প্রতিশ্রুতি রাখা। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে যাচ্ছি।’ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি কীভাবে লক্ষ্য অর্জন করবেন তা নিয়েও কিঞ্চিৎ ধারণা দিয়েছেন।
এর আগে, ২০২৩ সালে ফক্স নিউজকে এক সাক্ষাৎকারের সময় ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কি ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের লক্ষ্যবস্তু করবেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘না, না, না। তবে প্রথম দিন ছাড়া! আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দেব এবং তেল উৎপাদন করে যাব। এরপর, একটি বিষয় আমি বলতে চাই-আমি স্বৈরশাসক নই।’
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রচারণার সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে ৭টি প্রতিশ্রুতি তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। সেই অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার করা : নির্বাচনি প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় আকারে অবৈধ অভিবাসী’ বহিষ্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি প্রথম মেয়াদে শুরু হওয়া মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করারও অঙ্গীকার করেছেন। বাইডেন-কমলা প্রশাসনের অধীনে গত বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তবে ২০২৪ সালে তা কমে আসে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিপুলসংখ্যক অভিবাসী বহিষ্কারের বিষয়টি আইনগত এবং যৌক্তিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এই বিষয়টি মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মন্থর করে দিতে পারে।
২. অর্থনৈতিক সংস্কার, কর ও শুল্ক খাত : বুথ ফেরত বিভিন্ন জরিপের তথ্য বলছে, এবারের নির্বাচনে ভোটারদের কাছে অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রাম্প মুদ্রাস্ফীতি শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যদিও পরে তা আবার কমে আসে। ট্রাম্প এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ, একজন প্রেসিডেন্টের সরাসরি মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত খাতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা সীমিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের কর সংস্কারের সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যাপক কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত বন্ডের ওপর থেকে কর মুক্ত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ে কর বাতিল এবং কোম্পানি কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর বাইরে, তিনি বিদেশি পণ্যের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ নতুন শুল্ক প্রস্তাব করেছেন, যাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়। চীন থেকে আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের কথাও তিনি বলেছেন। তবে কিছু অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেছেন যে, এ ধরনের পদক্ষেপ পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে পারে।
৩. জলবায়ু নীতিমালা বাতিল বা সংস্কার : ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে শতাধিক পরিবেশ সুরক্ষা আইন প্রত্যাহার করেছিলেন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রথম দেশ হিসাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এবারও তিনি পরিবেশসংক্রান্ত আইন শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মূলত, আমেরিকার গাড়ি শিল্পকে সহায়তা করার লক্ষ্যে তিনি এ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। তিনি বারবার বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের সমালোচনা করেছেন এবং বাইডেন সরকার পরিবেশবান্ধব গাড়ির শিল্পের বিষয়ে যে নীতিমালা করেছিল তা বাতিল করার অঙ্গীকার করেছেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পুনর্নবিকরণযোগ্য শক্তি উৎস যেমন বায়ুশক্তি বা উইন্ডমিলের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। তিনি আর্কটিক অঞ্চলের মতো স্থানে তেল উত্তোলনের জন্য অনুমতি দিতে চান। তার মতে, এই বিষয়টি জ্বালানির দাম কমাতে সাহায্য করবে, যদিও বিশ্লেষকরা এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
৪. ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি : ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কিয়েভের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কয়েক হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে, তার সমালোচনা করে ট্রাম্প আলোচনার মাধ্যমে ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ এ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়টি কীভাবে অর্জিত হবে সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত তথ্য দেননি। তবে ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আরও উৎসাহিত করবে।
ট্রাম্প বিদেশি সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা কমাতে চান। গাজা যুদ্ধের বিষয়ে ট্রাম্প নিজেকে ইসরাইলের কট্টর সমর্থক হিসাবে তুলে ধরেছেন। তবে তিনি মার্কিন মিত্র দেশগুলোকে সামরিক অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি লেবাননেও সহিংসতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এর জন্য কী পদক্ষেপ নেবেন তিনি, তা স্পষ্ট করেননি।
৫. গর্ভপাত নিষিদ্ধকরণ ইস্যু : কিছু সমর্থকের আপত্তি সত্ত্বেও প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে কমলা হ্যারিসের বিপরীতে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে জাতীয়ভাবে গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা আইনে স্বাক্ষর করবেন না। ২০২২ সালে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট গর্ভপাতের ওপর সংবিধানিক অধিকার বাতিল করে।
গর্ভপাতের অধিকার ছিল কমলা হ্যারিসের নির্বাচনি প্রচারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ১০টি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনের দিন গর্ভপাতের অধিকার সংরক্ষণ বা সম্প্রসারণের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটগ্রহণ করা হয়। ট্রাম্প নিজেও বারবার বলেছেন, গর্ভপাত নিয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর নিজেদের আইন করার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
৬. ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার অভিযুক্তকে দায়মুক্তি : ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত কিছু ব্যক্তিকে তিনি ‘দায়মুক্তি’ দেবেন। ওই হামলার মাধ্যমে তার সমর্থকরা ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফলাফলকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী হয়েছিলেন। হামলার সহিংসতায় কয়েকটি মৃত্যুর জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করা হয়। ট্রাম্প এই হামলায় উসকানি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি হামলার গুরুত্ব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছেন এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া কয়েকশ সমর্থককে রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। এখনো তিনি দাবি করছেন, তাদের অনেকেই ‘অপরাধী নয়’, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, কিছু ব্যক্তি হয়তো আসলেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
৭. বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে চাকরিচ্যুত করা : ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘দুই সেকেন্ডের মধ্যে’ তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে তিনি চাকরিচ্যুত করবেন। বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উলটে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে এবং গোপনীয় তথ্যের ভুল ব্যবস্থাপনার অভিযোগে দুটি অভিযোগ এনেছেন।
তবে ট্রাম্প এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং মামলা দুটি নির্বাচনের আগে বিচার শুরু হতে না দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, স্মিথ তাকে একটি ‘রাজনৈতিক শিকারে’ পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। নিউইয়র্কে ব্যবসায়িক নথিপত্র জালিয়াতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ট্রাম্প হলেন এমন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।