সওজ ও গণপূর্তে ঠিকাদারির ‘ডন’ রায়হান
স্ত্রীর ভাগ্যে বাজিমাত
দুদকের প্রাক-অনুসন্ধান: মাত্র ছয় বছরে সড়কে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়েছে রায়হানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বল্পসময়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরে ‘ডন’ হিসাবে পরিচিতি পান রায়হান মুস্তাফিজ। গণপূর্তের বড় বড় কাজেও ছিল তার একচেটিয়া প্রভাব। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে একক ও যৌথভাবে শুধু সড়কের ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় রায়হানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)।
অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটিকে একের পর এক বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। এতে বিস্মিত হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা; কিন্তু কিছু বলতে পারেননি। এখন তারা বলছেন, ক্ষমতার কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল তাদের চোখ। রায়হানের স্ত্রী পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা সাবেক চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটনের স্ত্রীর বোন। এ সুবাদে লিটনের ভায়রা হওয়ায় রায়হানের দাপটে সবাই ছিলেন অসহায়। ভায়রার তদবিরেই সড়কের ঠিকাদারি কাজের ‘মাফিয়া চক্রের’ সদস্য বনে যান তিনি। ব্যবসায়িক অংশীদার করেন ববি সিদ্দিকীকে। তাদের পেছন থেকে মদদ দেন তারেক সিদ্দিকী। তাদের সবাই রায়হানের শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়।
অনেকেই বলেছেন, কার্যত স্ত্রীর ভাগ্যে ক্ষমতার দাপটে বাজিমাত করেন রায়হান। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মদদদাতারা আত্মগোপনে গেলে রায়হান ভোল পালটে প্রভাব অটুট রাখার চেষ্টা করছেন।
এদিকে আলোচিত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার জালিয়াতিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ বাগাতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে প্রাক-অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদকে জমা অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রাক-অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয় বিদায়ি কমিশন। অভিযোগসংক্রান্ত নথিপত্রের সূত্র ধরে যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানা যায়, একসময় গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রায় একচেটিয়া কাজ করত রায়হান মুস্তাফিজের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই। সড়কের ঠিকাদারি কাজে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তাদের। ২০১৭ সালের শেষভাগে সড়কের কাজে নেমেই ক্ষমতার প্রভাবে বাজিমাত করেন। মাত্র ছয় বছরে তারা সড়কে একক ও যৌথভাবে ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়, যা মোট কাজের ১০ শতাংশ। এ কাজ বাগাতে তারা টেন্ডার জালিয়াতি থেকে শুরু করে নানা অসদুপায় অবলম্বন করেছেন বলে দুদকের কাছে তথ্য আছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
দুদক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন এ প্রতিবেদক। কর্মকর্তাদের ভাষ্য-লিটন চৌধুরীর আত্মীয় হিসাবে এনডিই কর্ণধার রায়হান সড়কের কাজের ‘মাফিয়া সিন্ডিকেটে’ ঢুকে যান। এরপর সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কাজ বাগাতে তিনি সরাসরি মন্ত্রীর মাধ্যমে প্রভাব খাটাতেন। মন্ত্রী অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্তাদের বলে দিতেন, প্রতিষ্ঠানটির পেছনে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ অনেকেই। ফলে টেন্ডার ডকুমেন্ট ঠিক না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে বাধ্য ছিলেন তারা।
অধিদপ্তরের পৃথক সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখন মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেরা সাধু সাজার চেষ্টা করছেন। প্রকৃতপক্ষে শুধু সরকারের ক্ষমতাবানদের তদবির বা চাপে এনডিইকে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়নি। এর পেছনে অধিদপ্তরের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের কমিশন বাণিজ্যও রয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা দুদক ওই সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের সম্পদের হিসাব নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, পট পরিবর্তনের পর এনডিই কর্ণধার রায়হান মুস্তাফিজ বিএনপির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে আঁতাত করে সড়কের কাজে তার প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
জানা যায়, সওজের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে এক হাজারের বেশি। কিন্তু বিগত দিনে সড়কের মোট কাজের ৯০ শতাংশ করেছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সড়কের কাজে মাফিয়াচক্র গড়ে উঠেছিল। এ চক্রের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এনডিই। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শক্তিশালী এ চক্রের ঠিকাদারদের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের যোগসাজশ ছিল।
এনডিই-এর কাজের তালিকা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ কাজ বাগানো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, এনডিই, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, এমএস সালেহ আহমেদ, এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন ও মাহফুজ খান লিমিটেড। এ ধরনের ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এরা কাজ পেতে জালিয়াতি ও অনিয়ম করেছে-এমন প্রমাণ পাওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এনডিই-এর নামও আছে।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, বিগত সরকারের আমলে কাকে কাজ দেওয়া হবে, তা ঠিক করে দরপত্র ডাকার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো। এখন এটা চলবে না। প্রতিযোগিতা বাড়াতে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হবে। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগের কথাও জানান তিনি।
সওজ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে, সড়কে মাত্র ছয় বছর কাজ করেই এক যুগের বেশি সময় সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ঢুকে গেছে আলোচিত প্রতিষ্ঠান এনডিই। তালিকার তিন নম্বরে আছে প্রতিষ্ঠানটি। সাগর ইনফো বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কে ৩৯টি কাজ করেছে। এসব কাজ এনডিইর সঙ্গে যৌথভাবে করেছে তারা। জাল ও ভুয়া নথি জমা দিয়ে ঠিকাদারি কাজ নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পেয়ে ৬ জুলাই এনডিইকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তখন তারা উচ্চ আদালতে যায়। আদালত নিষিদ্ধ করার ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
দুদক থেকে প্রাপ্ত অভিযোগসংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, ৬ বছরে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠতার দাপটে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ পেতে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি এনডিই। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাজ করে বিল তোলাসহ বেশি কাজ দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়ের মতো এন্তার অভিযোগ আছে। অভিযোগ উঠেছে-এনডিই কর্ণধার রায়হান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার একদফার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অর্থের জোগান দিয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তায় ব্যবহৃত এবং কর্মকর্তাদের নামে থাকা লাইসেন্সকৃত মারণাস্ত্র গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় ব্যবহার করা হয়।
অভিযোগ আছে-এনডিই রেডিমিক্স কোম্পানির নামে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছে। কোম্পানিটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান থেকে পাথর এবং চীন থেকে রেডিমিক্স সরঞ্জাম আমদানি করে। এসব আমদানিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমেও বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে।
দুদকের একজন সাবেক মহাপরিচালক জানান, সওজের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি কিছু কাজ করেছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক চাপে কমিটির কার্যক্রম খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কমিশন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার পর হয়তো এসব কাজে গতি পাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় বছরে এনডিই সড়কের যেসব বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে ফরিদপুর অংশের ৮ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টাকার কাজ, নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচল লিংক রোডের ৫ হাজার মিলিয়ন, কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন, জিনজিরা-কেরানীগঞ্জ-নবাবগঞ্জ-দোহার-শ্রীনগর রোডের ১ হাজার ৬৪০ মিলিয়ন, গফরগাঁও-বরমী-মাওনা সড়ক প্রকল্পের ৬৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন, মাওনা-শ্রীপুর-কাপাসিয়া-মনোহরদী সড়ক প্রকল্পের ৯৫৮ মিলিয়ন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৩২২ মিলিয়ন, পায়রা বন্দরের অ্যামবেকমেন্ট অ্যান্ড আর্থ প্রটেকশন কাজের ১ হাজার ৪২৯ মিলিয়ন, তেজগাঁওয়ে ডিটিসিএ ভবন নির্মাণের ১ হাজার ৮৫০ মিলিয়ন টাকার কাজ।
এছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বড় কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১ হাজার ৪৬৫ মিলিয়ন টাকার গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি ভবন নির্মাণের ১ হাজার ৫৪৮ মিলিয়ন, রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের ৮০১ মিলিয়ন, চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট কালচারাল ভবনের ১ হাজার ৬৫৯ মিলিয়ন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ অফিস ভবনের ১ হাজার ৭৪০ মিলিয়ন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি আট তলা ভবনের ৩৫২ মিলিয়ন, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ১ হাজার ৭৫২ মিলিয়ন, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ৯৩৮ মিলিয়ন, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ভবন নির্মাণের ২ হাজার ২০ মিলিয়ন, সচিবালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের ১ হাজার ৩৮ মিলিয়ন, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ভবনের ২৭৮ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন, ন্যাশনাল ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার ভবন নির্মাণের ১ হাজার ৫০০ মিলিয়ন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবন নির্মাণের ১৭৭ দশমিক ১১ মিলিয়ন এবং বাংলা একাডেমি ভবন নির্মাণের ২১০ মিলিয়ন টাকার কাজ।
জানতে চাইলে এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মুস্তাফিজ বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের ব্যবসায়িক সুনাম আছে। আগে গণপূর্তের কাজ বেশি করতাম। পরে সড়ক ও জনপথের কাজ শুরু করি। কাজের ক্ষেত্রে আমরা কাউকে ম্যানেজ করিনি, সেটি বলা যেমন ঠিক হবে না; তেমনই প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেছি, এটাও বলতে পারি না। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম থাকলে যাদের দেখার কথা তারা দেখতেন। আমরা কাজ নিয়ে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করে বুঝিয়ে দিয়েছি।