ভোটার টানার নানা কৌশল
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যু তুললেন ট্রাম্প
মাসুদ করিম
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি উত্তাপে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। রাত পোহালেই ভোট। এখন চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে জরিপগুলো। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন অনেক ভোটার। এইসব বিষয় চিন্তা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস ভোটার টানতে নানা কৌশল নিচ্ছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে ট্রাম্পের মন্তব্য তেমনই একটি কৌশলের অংশ বলে অনেকে মনে করেন। ভোটের মাত্র ৫ দিন আগে আলোক প্রজ্বালনের উৎসব দীপাবলি উপলক্ষ্যে হিন্দু সম্প্রদায়কে দেয়া শুভেচ্ছা বার্তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প কড়া ভাষায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। এই ব্যাপারে নির্বিকার থাকায় তিনি কমলা ও বাইডেনের সমালোচনাও করেন। ট্রাম্প মনে করেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্সে লিখেছেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘূদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। মব আক্রমণ ও লুটপাট হচ্ছে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘এটা আমার নজরদারিতে থাকলে ঘটত না। কমলা এবং জো সারা বিশ্বে এবং আমেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করেছে। তারা ইসরায়েল থেকে ইউক্রেন এমনকি আমাদের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত বিপর্যয় এনেছে। কিন্তু আমরা আমেরিকাকে আবার শক্তিশালী করব এবং শক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনব।’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট এক্সে লেখেন, ‘আমরা হিন্দু আমেরিকানদেরও কট্টরপন্থি বামপন্থিদের ধর্মবিরোধী এজেন্ডা থেকে রক্ষা করব। আমরা আপনার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। আমার প্রশাসনের অধীনে আমরা ভারত এবং আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের মহান অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করব।’
যুক্তরাষ্ট্রে পপুলার ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেকটিতে জনসংখ্যা ও অন্যান্য বিবেচনায় বিভিন্ন সংখ্যায় ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে। এই ৫০টি অঙ্গরাজ্যের বাইরেও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি যাকে বলা হয় ‘ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া’ তার অধীনে রয়েছে তিনটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ অঙ্গরাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া মিলে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। তার মধ্যে যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট লাভ করবেন তিনি জয়ী হবেন। কোনো অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী জয়ী হবেন সেই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট তিনি লাভ করবেন। অর্থাৎ উইনার্স গেট অল। তবে ৫০টি রাজ্যের সবই ভোটের ফ্যাক্টর নয়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ঘাঁটিগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অনায়াসে জিতে যান। রিপাবলিকান ঘাঁটিতেও রিপাবলিকান প্রার্থী অনায়াসে জয়ী হন। ফলে এসব অঙ্গরাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে যায়। এসব রাজ্য ভোটে কোনো ফ্যাক্টর নয়। ভোটের মূল ফ্যাক্টর হলো সুইং স্টেট। যুক্তরাষ্ট্রে এমন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য আছে সাতটি। এগুলো প্রত্যেকটির ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যাও বিভিন্ন। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য উইসকনসিনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ১০টি, পেনসিলভেনিয়ায় ১৯টি, অ্যারিজোনায় ১১টি, জর্জিয়ায় ১৬টি, মিশিগানে ১৫টি, নেভাদায় ৬টি এবং নর্থ ক্যারোলিনায় ১৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট আছে। এই অঙ্গরাজ্যগুলো মূল যুদ্ধক্ষেত্র। এসব সুইং স্টেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে খুব কম ভোটে কোনো প্রার্থী জয়ী হয়ে অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেতে পারেন। তাই এসব রাজ্যে প্রতিটি ভোট মহামূল্যবান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের ভোট বড় কোনো ফ্যাক্টর নয়; তথাপি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে স্বল্প ভোটও এবার বড় ফ্যাক্টর। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো ঝুঁকি না নিয়ে কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানের ভোট লাভের প্রত্যাশায় সংখ্যালঘু কার্ড খেলে থাকতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ ভোট হলো ট্রাম্পের মূল ভোট ব্যাংক। ‘হোয়াই সুপ্রিম্যাসি’ দেখিয়ে সাদা বর্ণের বর্ণবাদী খেলায় ট্রাম্পের জুড়ি নেই। তবে বারাক ওবামাকে মাঠে নামিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ভোট কমলার কব্জায়। মেক্সিকোসহ দক্ষিণ আমেরিকার হিস্পানিকরা কমলাকে ভোট দেবেন বেশি। গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়ার অঙ্গীকার করে কমলা নারী ভোট টানার চেষ্টা করছেন। এশিয়ান অভিবাসীদের ভোট বিভক্ত। ভোটের এমন হিসাবে তাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোট মহামূল্যবান। যুক্তরাষ্ট্রে এবার ২৫ কোটি ভোটারের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোট ২৬ লাখ। ভারতীয় মায়ের সন্তান কমলা হ্যারিস তার বেশিরভাগ ভোট পাবেন। কিন্তু কট্টর হিন্দুরা ট্রাম্পকেও ভোট দিতে পারেন। এ কারণে ট্রাম্পের এই সংখ্যালঘু মন্তব্য। ট্রাম্পকে এই মন্তব্যে উৎসাহিত করতে পারে কট্টর হিন্দু লবি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন। ইলন মাস্ক একাই দিয়েছেন ৭৬ মিলিয়ন ডলার। ট্রাম্প জিতলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে এমন কারণে হতাশাগ্রস্তরা ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকবেন। গাজায় হামলার জন্য ইসরাইলে বিপুল বরাদ্দ দিয়ে তরুণ সমাজকে ক্ষুব্ধ করেছে জো বাইডেন প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ বলপ্রয়োগ করে দমন করা হয়েছে। তাই এই তরুণরা ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক আছে। তবে কমলা হ্যারিস কম খরচে স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছেন। ফলে বয়স্করা কমলাকে ভোট দিতে পারেন। কমলার জয় নির্ভর করছে নারী ভোটারের উপস্থিতি, ডেমোক্র্যাট ভোটারদের উপস্থিতি কেমন হয় তার ওপর। ট্রাম্প এবার এমনিতে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তবে অনেক ভোটারই গোপন রেখেছেন মনের ইচ্ছা। শেষ মুহূর্তে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। ফলে জয়-পরাজয় কী হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোটের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত।