আদানির আবারও আলটিমেটাম
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশকে এবার পুরোপুরি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে আদানি পাওয়ার। ৭ নভেম্বরের মধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় এ কোম্পানি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ অক্টোবর বকেয়া পরিশোধের নির্ধারিত সময়সীমা পার হওয়ার পর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত পূরণ করেনি বিপিডিবি। বকেয়া পরিশোধে বিলম্বের কারণে আদানি পাওয়ার ৩১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ ৮শ মেগাওয়াট কমিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আলটিমেটাম দিয়েছে ৩ নভেম্বর। এতে বলা হয়, ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। তবে বাংলাদেশে অবস্থতি আদানির জনসংযোগ বিভাগের দাবি, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য সঠিক নয়। তারা ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া ৮৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের কোনো আলটিমেটাম দেয়নি। সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য তারা পিডিবিকে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করতে রাজি আছে। পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের (পিজিবি) ওয়েবসাইটে শুক্রবার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের গড্ডা প্ল্যান্ট ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট স্থাপন ক্ষমতার বিপরীতে ৭২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী, এর পরের স্থানে রয়েছে পায়রা (১,২৪৪ মেগাওয়াট), রামপাল (১,২৩৪ মেগাওয়াট) এবং এসএস পাওয়ার আই (১,২২৪ মেগাওয়াট) প্ল্যান্ট।
খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ডলার সংকটের কারণে সময়মতো অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতীয় বিদ্যুৎকোম্পানি আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে জটিলতা কাটছে না। জুলাই থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার বাড়তি দাম ধরে বিদ্যুৎ বিল করছে আদানি। বকেয়া বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে চাপও দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অর্ধেকের নিচে নামিয়েছে তারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘একতরফা’ চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে আদানি পাওয়ার পুরোপুরি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে এ মুহূর্তে ২৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাবে। কারণ, কয়লা সংকটে ২৫ অক্টোবর থেকে মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কয়লা আমদানি করতে না পারায় এখান থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করতে সময় লেগে যেতে পারে চলতি মাসের শেষ নাগাদ। এ অবস্থায় আদানি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে প্রায় ২৭শ মেগাওয়াট উৎপাদন কমে যাবে। যদিও শীত চলে আসায় বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে গেছে। এ কারণে এ মুহূর্তে বড় প্রভাব পড়বে না।
আদানির কয়লার দাম সবচেয়ে বেশি : আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগেই কয়লার দাম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। জুলাই থেকে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার বাড়তি দাম ধরে বিল প্রদান করে। এ বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে চাপও দেয় আদানি। কিন্তু কয়লার বিতর্কিত দাম দিতে অস্বীকৃতি জানায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। একপর্যায়ে দাম কমাতে রাজি হয় আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে কম দামে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেয় তারা। তবে এক বছর পর এখন আবার ২২ শতাংশ বাড়তি দাম চাইছে আদানি।
বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ ও বকেয়া পরিশোধের তাগিদের মধ্যে সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি। এতে বলা হয়, পিডিবি যাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়, নইলে আদানি ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে।
পিডিবি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। এ ঋণপত্র খোলার কথা ছিল কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু সেটি হয়নি। পিডিবি আরও সময় লাগবে বলে জানায়। কিন্তু আদানি পিডিবির কথায় রাজি না হয়ে ১ নভেম্বর রাত থেকে একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয়।
পিডিবি তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। আর আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। এর মানে, প্রতি টন কয়লায় পায়রা ও রামপালের চেয়ে ২১-১৬ ডলার বাড়তি চাইছে তারা।
কয়লাভিত্তিক আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। দ্বিতীয় ইউনিটে শুরু হয় একই বছরের জুনে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে কয়লার দামের বিষয়টি সুরাহা করেছিল আদানির প্রতিনিধিদল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের জন্য কয়লার প্রকৃত দামে বিল করেছে তারা। জুলাই থেকে চুক্তি অনুসারে কয়লার বিল করছে আদানি।
আদানির বক্তব্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে কয়লার ‘প্রাইস ইনডেক্স’ বা মূল্যসূচক অনুসারে বিল জমা দিচ্ছে আদানি। কোনো কিছু পরিবর্তন করা হয়নি। তাই কয়লার দাম বেশি ধরে বিল জমা দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সূত্র বলছে, প্রতি সপ্তাহে আদানির বিল পাওনা হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ থেকে আড়াই কোটি ডলার। এর বিপরীতে পিডিবি তাদের পরিশোধ করছে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের মতো। আগে পরিশোধের পরিমাণ আরও কম ছিল। এতে অক্টোবর পর্যন্ত তাদের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, আদানিসহ ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধে ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকা জমা দিয়ে রেখেছে পিডিবি। ডলারের সংকট থাকায় ব্যাংক নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না।
পিডিবির বক্তব্য অন্যসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কেনার বিল ধরেই খরচ হিসাব করা হয়। তবে আদানির সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি অনুসারে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সূচকের মধ্যে গড় করে মূল্য হিসাব করা হবে। গড় দাম ধরার কারণে আদানির বিলে বাড়তি দাম আসছে। আদানি বিশেষ ছাড়ে কয়লা কিনলেও সেই সুবিধা পাচ্ছে না পিডিবি।
সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকার আদানির সঙ্গে তাড়াহুড়া করে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে। আদানির নিজস্ব কয়লাখনি এবং ভারতে বড় একাধিক কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে তড়িঘড়ি করে চুক্তি করা হয়। আর এর সুযোগ নেয় আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর কয়লার দামের বিষয়টি পিডিবির নজরে আসে। বর্তমানে সবচেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে পায়রা। এ হিসাবে আদানির কয়লার দাম হিসাব করা হলে প্রতি টনে ২০ থেকে ২৫ ডলার কমে যাবে।
চুক্তি পর্যালোচনা করছে কমিটি : গত আওয়ামী লীগ সরকার দরপত্র ছাড়া চুক্তি করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১) করেছিল। এ আইনের অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। এ কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসাবে পরিচিতি পায়। এ আইনের অধীন করা চুক্তি পর্যালোচনা করতে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির সভায় ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত ও নথি কমিটিকে সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভারতের আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। কমিটিকে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
চুক্তি অনুসারে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া আছে। চুক্তিমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও দিতে হয়, না করলেও ভাড়া দিতে হয়। প্রথম কয়েক বছর এটি বেশি থাকে, ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আদানির চুক্তিতে প্রথম সাত বছর এটি একই ধরা আছে। এরপর ধীরে ধীরে এটি কমতে থাকবে। এ পর্যায়ে চুক্তি বাতিল করলে তাতে পিডিবির লোকসান হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পিডিবির অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আদানি তার সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করেছে চুক্তিতে। দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের চড়া সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রায় নেই। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব খরচের দায় পিডিবির। আদানির কেন্দ্রে বিনিয়োগের বিপরীতে সব সুদের হার ভারত নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেই। পানি ব্যবহারেরও খরচ দিতে হবে, যা পায়রায় নেই। এছাড়া কয়লা আমদানি, বন্দর ব্যবস্থাপনা ও পরিবহনে আদানি গ্রুপের নিজেদের অন্য দুটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। সব তাদের নিজস্ব কোম্পানি হওয়ায় পুরো বিষয়টিতে অস্বচ্ছতা আছে। জাতীয় স্বার্থে এ চুক্তি পর্যালোচনা করা উচিত বলে মত দিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিতে অনেক ধরনের বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে। পদে পদে সুবিধা নিয়েছে তারা। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার নিয়ে যাচ্ছে আদানি। এটি একটি একতরফা চুক্তি, সেই সুযোগটাই নিচ্ছে আদানি। তাই এ চুক্তি থেকে অবিলম্বে সরে আসা দরকার সরকারের। সরকার বাতিল করতে না পারলে আদালতে যাবে ক্যাব।