সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের
আমরা মরতে চাই দেখি কত লোক মারতে পারে
পুলিশের নিষেধাজ্ঞার পর জাতীয় পার্টির আজকের কর্মসূচি স্থগিত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, যে যেখানে আছেন, কেউ ভয় পাবেন না। আমরা মরতে আসছি, আমরা মরতে চাই। কত লোক মারবেন ওনারা, আমরা সেটা দেখতে চাই। মনে রাখবেন, ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। হাত দিয়ে প্রতিবাদ করতে না পারলে মুখ দিয়ে কর। মুখ দিয়ে না পারলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। আমাদের সেটা করতে হবে। তার জন্য আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। শুক্রবার রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আজ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও পরে তা স্থগিত করা হয়। রাতে পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কাকরাইলসহ আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশে পুলিশ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় আজকের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
এর আগে জাতীয় পার্টির বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে আজ রাজধানীর কাকরাইল ও এর আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। শুক্রবার ডিএমপি কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. মাইনুল হাসান স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আজ পাইওনিয়ার রোডের ৬৬নং ভবন, পাইওনিয়ার রোড, কাকরাইলসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় কোনো প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হলো।
সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের ২০০৮ সালের নবম সংসদ থেকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, শেরীফা কাদের, আলমগীর সিকদার লোটনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে জিএম কাদের বলেন, আমরা কোনো অপরাধ করিনি। আমাদের জোর করে অপরাধী করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে, আমরা জানি না। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের প্রটেকশন দিচ্ছেন বলে এখনো বেঁচে আছি, অন্য কারও প্রটেকশনে নয়। বিচারের জন্য যদি আল্লাহর সাহায্যের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, তাহলে দেশ কীভাবে চলবে। আমরা একদিনের ডেমোক্রেসি চাই না। সবসময়ের ডেমোক্রেসি চাই। আমরা চাই সরকার হবে ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’।
১৯৯০ সাল থেকে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করে জিএম কাদের বলেন, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর শুরুর দিকে সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও এখন মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর ষড়যন্ত্রটা এখনো চালু আছে। তিনি বলেন, আমাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলা হচ্ছে। কিন্তু দোসর কীভাবে, এর কোনো জাস্টিফিকেশন নেই। ২০০৮ সালে নবম সংসদে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করেছি। কিন্তু ওনার (শেখ হাসিনার) সব অপকর্মে আমরা একাত্ম ছিলাম না। এটা প্রমাণিত।
তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি, ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি। এরশাদ সাহেবকে জোর করে সিএমএইচে ভর্তি করে, দলের ভেতরে বিভক্তি সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র একটি অংশকে নির্বাচনে নেওয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও তারা একই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে। এটা কি সরকারকে বৈধতা দেওয়া হয়নি? ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনও আমরা করতে চাইনি, জোর করে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনা অনেকে দেখেছেন এবং জানেন।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অপরাধ, এমনটা পৃথিবীর কোথাও আছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, আমি রাজনীতি করি, আমার একটি দল আছে। আমার দল যার সঙ্গে ইচ্ছা অ্যালায়েন্স করব। যখন ইচ্ছা আমি নির্বাচন করব, যখন ইচ্ছা আমি নির্বাচন করব না। এটা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত, এখানে অপরাধটা কী। যখন আমি নির্বাচন করতে চাচ্ছি না, তখন আমাকে গায়ের জোরে নির্বাচনে নেওয়া হচ্ছে। আর যখন আমি নির্বাচনে গেলাম, তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে এবং আমার পরিবারকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে এবং ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি।
জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি জাতীয় পর্যায়ের একটি রাজনৈতিক দল। বারবার আমাদের কবরস্থ করার পরও আমরা কবর থেকে উঠে এসেছি। কেউ আমাদের ধ্বংস করতে পারেনি। যেহেতু আমরা সহাবস্থানের রাজনীতি করি, আমরা দখলদারি করিনি, সন্ত্রাসের রাজনীতি করি না, হাট-মাঠ-ঘাট দখল করিনি, মানুষকে অত্যাচার-দলীয়করণ করিনি। আমরা মানুষকে সুশাসন দিয়েছি, উন্নয়ন দিয়েছি, সংস্কার দিয়েছি, গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি। মানুষ তা স্মরণ করে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে আমরা কী রাজনীতি শুরু করেছি। আমি রাজনীতি করব আমার দল নিয়ে। আমার দল বিবেচনা করবে আমি কার সঙ্গে যাব। আমি বিবেচনা করব আমি কার সঙ্গে যাব না। আমার দল বিবেচনা করবে আমি নির্বাচনে যাব, আমার বিবেচনা আমি নির্বাচনে যাব না। এখানে জোর করা হচ্ছে এবং জোর করা হচ্ছে দুদিক থেকেই। খালি শেখ হাসিনা জোর করেছে, তা তো নয়। এর রেশ এখন পর্যন্ত চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জাতীয় পার্টির এবং ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, এখন যেটা দেশে দেখতে পাচ্ছি, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশ বিভক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, কিছু লোক এসে দেশটা দখল করে ফেলেছে। আমরা যে তাদের সহযোগিতা করেছি, সাধারণ জনগণ যে তাদের সহযোগিতা করেছে, সেটা তাদের কাছে এখন মনে হচ্ছে না। তারা দেশটাকে পবিত্র-অপবিত্র ভাগ করছে। তারা পবিত্র গ্রুপে আছে। এর মধ্যে কে দোষী, কে নির্দোষ-এটা ওনারাই ঠিক করে দেবেন। ঠিক যেভাবে দেশকে বিভক্ত করেছিলেন শেখ হাসিনা।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতির অভিভাবক মন্তব্য করে জিএম কাদের বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা যাকে আমরা জাতির অভিভাবক মনে করি। তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার সবচেয়ে ক্লোজ লোক আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। উনি কিছু বলেননি। এর মানে উনি মৌন সম্মতি দিয়েছেন বলে আমরা ধরে নিচ্ছি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে বলব, আপনি তো আমাদের, দেশের অভিভাবক। আপনি আমাদের সমান চোখে দেখেন। আমরা সবাই আপনার সন্তান। দোষত্রুটি সবারই থাকে। দোষত্রুটি থাকলে বিচার-আচার করে শাস্তি দেন, আবার কোলে তুলে নেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, জাতীয় পার্টি জনগণের রাজনৈতিক দল। হয়তো সারা দেশে আমাদের অবস্থান কিছুটা কম আছে, তবুও আমরা টিকে আছি। চাপে গর্তে ঢুকে গেলেও বারবার জাতীয় পার্টি উঠে দাঁড়ায়, এটাই অনেকের সহ্য হয় না। যে কারণে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়। জাতীয় পার্টি সবসময় জনবান্ধব দল ছিল, এখনো আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে।
জিএম কাদের বলেন, একটি গোষ্ঠী জাতীয় পার্টির নামে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে নানারকমের ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, সবাই বলে আমরা নাকি আওয়ামী লীগের দোসর। কিন্তু কীভাবে দোসর হলাম? আমরা শেখ হাসিনার কোনো ধরনের জনবিরোধী কাজের সঙ্গে ছিলাম না। আমরা বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের জনবিরোধী ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আওয়ামী লীগের দলীয়করণের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম।