স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ অভিমত
দুদকের সাংবিধানিক মর্যাদা জরুরি
দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর (প্রায় ২০ বছর) দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করা হয়। সেই থেকে দেশের দুর্নীতি দমনের জন্য গঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারের আজ্ঞাবহ হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাসহ বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযান পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। জেলে পাঠানো হয়। অনেকের সাজাও হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পালটে যায় অনেক কিছু। থমকে যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। এমনকি ভাটা পড়ে দুর্নীতির অনুসন্ধান-তদন্ত এবং বিচারেও। সেই থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ এককভাবে দলটির শাসনকালে বিরোধী দলের নেতাকর্মী-জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল দুদক। অন্যদিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতার লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ছিল ‘নীরব দর্শক’-এর ভূমিকায়। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের নেতা এবং দলটির আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালীদের বিরদ্ধে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর সময় করা সব মামলা থেকে ‘দায়মুক্তির সনদ’ বা ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছে নির্বিচারে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় দুদকের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে দুদকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া এ মহূর্তে জরুরি হয়েছে পড়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
দুদকের কেমন সংস্কার হলে দেশ থেকে দুর্নীতি কমবে, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র পাবে দেশের মানুষ-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, দুদকের সাবেক একাধিক মহাপরিচালক, বর্তমান মহাপরিচালক ও পরিচালক এবং দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে কাজ করেন-এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা তাদের কাজের অভিজ্ঞতা, সমস্যা, সংকট, দুদক আইন ও বিধিমালার ত্রুটি, ভবিষ্যৎ দুদক কেমন হবে, কীভাবে দুর্নীতি দূর করে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়-এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত, যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তাদের মতে, দুদক আইন যখন করা হয়, দেশে তখন দুর্নীতির এমন ভয়াবহতা ছিল না। ফলে আইনে দুর্নীতির সংজ্ঞাও সঠিকভাবে বিন্যাস হয়নি। দুদক আইনে ‘তফশিলভুক্ত অপরাধ’-এর স্থলে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। ২০০৪ সালের পরে কয়েক দফায় আইনে ছোটখাটো সংশোধনী আনা হলেও তা ছিল অসম্পূর্ণ। তাদের মন্তব্য-দুদকের ব্যর্থতার দায়ভার দুদকের একার, তাও বলা যাবে না। দুর্নীতি দমনের কাজটা সরকারের। সরকার সেটা দুদককে দিয়েছে। দুদক কেন পারছে না, এর দায়ভার সরকারেরও। দুদকের ওপর দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক দল ও সরকার সুবিধা নিয়েছে। তবে দুদককেও ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত-দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় আইনে ব্যাপক পরিবর্তন করে দুদককে ক্ষমতা দিতে হবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে। ২০০৪ সালের আইনের ৩(২) ধারায় বলা আছে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হবে’-এই কথিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার নামে পক্ষপাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচন কমিশন বা অডিটর জেনারেল বা পিএসসির মতো দুদককেও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারা দুদকে কমিশনার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, শপথের মাধ্যমে তাদের দায়িত্বে আসতে হবে। কাজ করতে গিয়ে শপথ ভঙ্গ করলে সংবিধান অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুদককে সংবিধানের আওতায় আনার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি দমনে স্বাধীন সংস্থা থাকে। তারা সরকারের কোনো মন্ত্রী দুর্নীতি করলেও ধরে। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। দুদককে নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক বডি করা উচিত। এ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে ক্ষমতা দিতে হবে। ১৬ বছর ধরে দুদকের চেয়ারম্যান কমিশনাররা রাজনৈতিকভাবে বাড়াবাড়ি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে।
প্রসঙ্গত, এ মুহূর্তে দুর্নীতি সারা দেশে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় তার ঘনিষ্ঠরা ২ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করেছেন। এর বাইরেও বিগত সরকারের সময়ে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে আসে তার পিওন জাহাঙ্গীর চারশ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু সেই সময় জাহাঙ্গীরের দুর্নীতিও ধরতে পারেনি দুদক। চারশ কোটি টাকার বাইরেও দেশে-বিদেশে জাহাঙ্গীরের আরও কত সম্পদ আছে, এর কোনো হিসাব নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর একজন পিওনের দুর্নীতির এত সম্পদ থাকলে তার আশপাশে যারা ছিলেন, অর্থাৎ চার দফায় মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, দলের নেতা হয়েছেন, পদপদবি পেয়েছেন, দলকে বিনা ভোটে ক্ষমতায় আনতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা কাজ করেছেন-তারা কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন, তা ধারণারও বাইরে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এত বছর যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে, সেদিকে নজর দেয়নি দুদক। নজর দেয়নি বড় বড় প্রকল্পের নামে ‘সাগরচুরি’র ঘটনার দিকেও।
দুদকের শীর্ষপদে যারা আসীন হন, তাদের নিয়োগ হয় রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায়। সরকারের আনুকূল্যে নিয়োগ পাওয়ায় তারা সরকারকে বিব্রত করতে চায়নি। উপরন্তু মন্ত্রী তো দূরের কথা, কোনো এমপি বা সরকারদলীয় নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যম বা অন্য কোনো সূত্রে পেলেও অনুসন্ধান শেষে তারা পেয়ে যান ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’। চুনোপুঁটি ধরার ক্ষেত্রে বা তাদের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের যতটা মনোযোগ ছিল-আমলা, পুলিশ প্রশাসন বা সরকারের অন্য দপ্তরের বড় পদের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ধরার ক্ষেত্রে ততটাই ছিল নমনীয়। সরকারদলীয় কোনো প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা বা সাজার ঘটনারও তেমন নজির নেই। এমন বাস্তবতায় বর্তমান অনন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে দুদক সংস্কারে একটি কমিটি করে। তারা অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে সংস্কার প্রস্তাব দেবে সরকারকে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি ২০১২ সালে দুদকের জন্য একটি আইনের খসড়া করেছিলাম। এতে সহায়তা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব, সংস্থাপন সচিব, তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার। তারা যেভাবে রিপোার্ট বা সুপারিশ দিয়েছিলেন, সেভাবে সংসদে পাশ হলে দুদক আইনগতভাবে আরও শক্তভাবে কাজ করতে পারত। কিন্তু আমার সময়ে সেটি আর জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। আমি চলে আসার পর তা সংসদে তোলা হলো। কিন্তু আইনটি কাটাছেঁড়া করে দুর্বল করে দেয় সরকার।
দুদকের কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ ও বাছাই কমিটির জন্য বিধিমালা : ২০০৪ সালের দুদক আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী দুদকের তিনজন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটি গঠন বা এর কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বিধিমালা না থাকায় সরকারের পছন্দের বাইরে কাউকে নিয়োগের সুপারিশ করতে পারে না এ কমিটি। আইনে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। আইন করার পর থেকে গত ২০ বছর সরকার গঠিত বাছাই কমিটি দিয়েই ছয়জনের নাম গোপনে বাছাই করে, পরে তাদের মধ্য থেকে তিনজনকে নিয়োগ দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর জন্য কোনো বিধি নেই। সরকারের খেয়ালখুশিমতো যাকে-তাকে গোপনে বাছাইয়ের নামে তাদের মধ্য থেকে তিনজনকে নিয়োগ দেয়। তারা বলেন, এ বাছাইয়ের কাজটি গোপনে করা যাবে না। কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ হতে হবে। যদি বর্তমান সিস্টেম অনুযায়ী ছয়জনের মধ্যে তিনজন কমিশনার নিয়োগের বিধান চালু থাকে। তবে বাছাই কমিটি যে ছয়জনের নাম প্রস্তাব করবে, তা বিধি অনুযায়ী গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশ সরকার বা দুদকের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। কমিশনার হওয়ার জন্য কারও আগ্রহ (ইও-এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আছে কি না, তা জানতে প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। যোগ্যরা আবেদন করবেন। তাদের মধ্য থেকে ছয়জনকে (যাদের মধ্যে তিনজনকে চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ করেন রাষ্ট্রপতি) কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাও জানাতে হবে। আবেদনকারীদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। যাচাই-বাছাই করার একটি মাপকাঠি থাকতে হবে। দেখতে হবে দুর্নীতি দমন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার কোনো ভূমিকা আছে কি না। রাষ্ট্রের জন্য তার অবদান কী, দেশের জন্য তিনি কী কী করেছেন, দুর্নীতি বা সুশাসনসংক্রান্ত কোনো গবেষণা বা পাবলিকেশন্স আছে কি না, দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত কাজে কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে কি না-এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত কার্যক্রমে অভিজ্ঞতা নেই-এমন লোক এতদিন নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের কাজ বুঝতেই বছর চলে যায়।
দুদকের বর্তমান আইন অনুযায়ী কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন, শিক্ষা, প্রশাসন ও শৃঙ্খলা বাহিনীতে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ কয়েকটি যোগ্যতার বাইরেও নতুন করে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিয়ে কাজ করেছেন-এমন যোগ্য লোককে যুক্ত করা দরকার। কমিশনার নিয়োগে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দল ও দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজকে বাছাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তারা বলেন, একই ক্যাডার সার্ভিস থেকে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এটির ফল অতীতে ভালো হয়নি।
হংকংয়ে দুর্নীতি দমন সংস্থার প্রধানের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত ক্ষমতা। কিন্তু বাংলাদেশের দুদকে প্রধান হিসাবে একজন চেয়ারম্যান থাকলেও তার এককভাবে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আদলে দুদক প্রধানের অধীনে দুজনের স্থলে চারজন সদস্য রাখা যেতে পারে। কারণ, এ মুহূর্তে অর্থ পাচারসহ দুর্নীতির আকার-প্রকৃতি বেড়েছে। ঋণখেলাপি বেড়েছে। এছাড়া যারা সরকারের অন্য দপ্তর থেকে দুদকে প্রেষণে আসবেন, তাদের মেয়াদ হতে হবে দুই বছর। প্রেষণে কোনো কর্মকর্তাকে দুদকে আনতে হলে দুর্নীতি দমন নিয়ে কাজ করেছেন বা এ সংক্রান্ত পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকতে হবে তার। দুদকে যাদের প্রেষণে আনা হয়, তাদের পরিচয় ওয়েবসাইটে দিতে হবে। নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে দুদকের শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে।
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদককে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে একদিকে যেমন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তেমনই সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিলের পর তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের বিষয়ে আইনে বলা আছে। কিন্তু এরপর কী হবে! নিয়ম হচ্ছে-জাতীয় সংসদে দুদকের এক বছরের কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করা। সরকার ও বিরোধী দলের সবাই তাতে অংশ নেবেন। এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি কী কাজ করেছে, কী করতে পারেনি, কেন পারেনি-সেই আলোচনা হবে। দুর্নীতি দমনে বা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্তে এক বছরে সফলতা-ব্যর্থতার তথ্য তুলে ধরে এর সমাধানের পরামর্শ দেবেন আইনপ্রণেতা ও সংসদ-সদস্যরা। বিগত বছরগুলোয় এ ধরনের কোনো আলোচনা বা দুদক নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি। অর্থাৎ, বাস্তবে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের মতো চলেছে দুদক।
দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক বাধা : দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের অংশ হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। যে তথ্য ছাড়া দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি বা মামলা করাও অসম্ভব। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় দুদক সরকারের দপ্তরগুলো থেকে তথ্য সহায়তা খুব পায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক কর্মকর্তারা বলেন, কোনো প্রকল্প বা সরকারের আমলা কিংবা প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলে তা শেষ করার জন্য সরকারি দপ্তরের কাছে চিঠির পর চিঠি দেওয়ার পরও সাড়া পাইনি। সরকারের উপরমহল থেকে বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও অনেক সময় বলে দেওয়া হয় তথ্য না দিতে। ফলে অনুসন্ধান ঝুলে থাকে, অথবা ফাইলটি নিষ্পত্তি করা ছাড়া উপায় থাকে না। তারা বলেন, দুদকের গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান তদন্তের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়টি দুদক আইনে সময়োপযোগী সংশোধনী এনে তাতে একটি ধারা হিসাবে সংযোজন করতে হবে।
সরকারের সঙ্গে দুদকের মধ্যস্থতাকারী পৃথক সচিবালয় প্রয়োজন : দুদক আইন অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে দুদকের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু এ বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় দুদক তেমন সহযোগিতা পায়নি। দুদকের কাছ থেকে ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার আইনের ধারাটি সরিয়ে সিআইডি ও বিএফআইইউসহ অন্য ৭টি দপ্তরকে দেয় সরকার। দুদক দুই বছর ধরে চেষ্টা করছে সেই ধারায় তাদের অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা অর্পণের জন্য। প্রয়োজনে সিআইডিসহ অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে অর্থ পাচারের তদন্তের জন্য দুদককে সুযোগ করে দিতে। কিন্তু সরকার সেই কাজটি করেনি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও এ নিয়ে দুদকের পক্ষে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখেনি। এ সসস্যা নিরসনে লিয়াজোঁ প্রতিষ্ঠান হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের স্থলে পৃথক একটি সচিবালয় গঠন করা যেতে পারে। যে প্রতিষ্ঠান দুদককে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস : সংশ্লিষ্টদের মতে, দুদককে শক্তিশালী করতে হলে এর অর্গানোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করতে হবে। জনবলের স্বতন্ত্র আইডেনটিটি থাকতে হবে। দুদকের জন্য স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস করতে হবে। তাদের বেতন কাঠামো, নিয়োগে নিজেদের হাতে স্বাধীন ক্ষমতা থাকতে হবে। পাশাপাশি দুদকের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে অনুসন্ধান তদন্ত ও বিচারকাজ কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।