শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের ২ লাখ কোটি টাকা পাচার
দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ
পাচারে সহায়তাকারী সরকারের নীতিনির্ধারক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা দেশে রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে -অধ্যাপক মইনুল ইসলাম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচারকারী এবং তাদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দেশে থাকা তাদের (পাচারকারী-সহায়তাকারী) সব সম্পদ জব্দ করে বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে এ প্রক্রিয়াটি যত স্বচ্ছ হবে, বিদেশে এর গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে। পাচারকারীদের পাশাপাশি তাদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে পাচারের প্রবণতা কমতে পারে। একই সঙ্গে পাচার করা টাকার সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। গত সরকারের সময়ে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, পাচারকারী ও পাচারে সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়-এ বিষয়ে সোমবার যুগান্তরের সঙ্গে পৃথক আলাপচারিতায় দেশের খ্যাতিমান দুই শীর্ষ অর্থনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি এসব কথা বলেছেন। তারা হলেন-বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তাদের আরও অভিমত-পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ ও জটিল। এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে পাচার করা টাকা ফেরানো সম্ভব হবে না। আইন অনুযায়ী লেগে থাকতে হবে। যখন যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এতে চট করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারের একাধিক সংস্থা জড়িত রয়েছে। তাদের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়সাধন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ লাখ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ একাই সরিয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে তাদের সহায়তা করেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেছেন, গভর্নর টাকা পাচারের যে তথ্য বিদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, সেটি নতুন কিছু নয়। এ তথ্য তিনি আগেও বলেছেন। পার্থক্য হলো আগে তিনি টাকার অঙ্কে বলেছেন, এবার বলছেন ডলারের হিসাবে। গত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম একাই পাচার করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকেই পাচার করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যরা পাচার করেছেন ৮০ হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা সহজে ফেরত আনা সম্ভব নয়। কারণ, পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। এত দীর্ঘসময় সরকার লেগে থাকে না। ফলে পাচার করা টাকা ফেরত আসে না। সরকার পরিবর্তন হলে পাচার করা টাকা দেশে আনার প্রক্রিয়াটিও ঘুরে যায়।
পাচার করা টাকা এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়-এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেগুলো পাচার করা হয়েছে, সেগুলো ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ওইসব টাকা যেসব দেশে পাচার করা হয়েছে, ওইসব দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ওই টাকা পাচারকারী ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য দ্রুত তদন্ত করে মামলা করতে হবে। তারপর আদালতের রায়ের মাধ্যমে তা বিদেশে পাঠাতে হবে। একই সঙ্গে দেশে থাকা তার সম্পদ জব্দ করতে হবে। এস আলম গ্রুপের যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর সম্পদ সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। যেসব পাচারকারী বিদেশে চলে গেছে, তাদের ধরতে হলে যে দেশে গেছে, সে দেশের আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। পাচারে সহায়তাকারী সরকারের নীতিনির্ধারক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা দেশে রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তাদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হচ্ছে-পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা। এ কারণে এক্ষেত্রে তাদের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, গত সরকারের আমলে যে টাকা পাচার করা হয়েছে, এর পরিমাণ অনেক। ওইসব টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। বড় বড় টাকা পাচারকারী ইতোমধ্যে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। এখন আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের অনেক সহযোগীও পালিয়ে গেছেন। টাকা পাচারকারী এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাচারকারীদের পাশাপাশি যদি তাদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পাচারকারীদের সহায়তা করা বন্ধ হবে। তখন পাচারের পথও সীমিত হয়ে যাবে। তিনি আরও বলন, দেশের ব্যাংক থেকে কীভাবে টাকা পাচার হয়েছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। কারণ, ব্যাংক খাত তদারকি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়ার সঙ্গে কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্যিক ব্যাংক, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত রয়েছে। পাচারের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত। অথবা তারা নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। কেন করেননি, না করলে তারা কীভাবে লাভবান হয়েছেন-এসব দেখার দরকার আছে। পাচার করা টাকার সুবিধাভোগী কারা, সেটিও দেখতে হবে। গত সরকারের আমলে এক পক্ষ টাকা পাচার করেছে, আরেক পক্ষ সহায়তা করেছে এবং একটি পক্ষ তা ভোগদখল করছে। এমন তথ্য গণমাধ্যমে বেরিয়েছে। তিন পক্ষেরই কারা কীভাবে জড়িত, তা শনাক্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গভর্নর টাকা পাচারের যে তথ্য দিয়েছেন, সেটি কেবল ব্যাংক খাতের। এর বাইরে অন্য খাত থেকেও টাকা পাচার করা হয়েছে। এর পরিমাণও কোনো অংশেই কম নয়। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও সরকারের একাধিক সংস্থা জড়িত। এর মধ্যে আছে বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার উদাহরণ আছে। সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। যারা পাচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধ যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনই তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও নিতে হবে। গত সরকারের আমলে দেশ থেকে যেসব টাকা পাচার করা হয়েছে, এর একটি বড় অংশের সুবিধাভোগী অন্য পক্ষ। এ পক্ষকে তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পাচার করা টাকা যাতে পাচারকারী এবং এর সুবিধাভোগীরা ব্যবহার করতে না পারেন, সেজন্য দেশের সম্পদের পাশাপাশি বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করতে হবে। দেশের সম্পদ জব্দ করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করতে হলে দুর্নীতির দায়ে দেশের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে-এ বার্তা যখন পাচারকারী দেশে যাবে, তখন তারা পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করতে সহায়তা করবে। কারণ, বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পাচার করা সম্পদ জব্দ করার নিয়ম এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। আপাতত পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরানো সম্ভব না হলেও সেগুলোর ওপর পাচারকারীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।