Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

স্ত্রীকে নিয়ে সালাম মুর্শেদী গড়ে তোলেন এমপি লীগ

Icon

আহমদ মুসা রঞ্জু, খুলনা

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্ত্রীকে নিয়ে সালাম মুর্শেদী গড়ে তোলেন এমপি লীগ

ফুটবল মাঠের এক সময়ের দাপুটে খেলোয়াড় আব্দুস সালাম মুর্শেদী এমপি হওয়ার পর রাজনীতির মাঠেও একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সংসদীয় এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিবাদ করলে বা মতের মিল না হলে এলাকার মানুষের ওপর নেমে আসত নির্যাতন। রেহাই পাননি নারীও।

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের অরাজকতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। গড়ে তোলেন এমপি লীগ। তার এসব কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিলেন নির্বাচনি এলাকার মানুষ। নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করেছিলেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। ঢাকার গুলশানে বাড়ি দখল কেলেঙ্কারি ও আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে ফিফার জরিমানার মুখেও পড়েন তিনি।

এলাকায় দলীয় কোন্দল সৃষ্টি, দখল বাণিজ্য, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, সরকারি প্রকল্পে পছন্দের ব্যক্তিদের সুবিধা দিয়ে নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেন। নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন। স্ত্রী ও মেয়েকে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে করতেন অর্থ লোপাট।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে খুলনার রাজনীতিতে যুক্ত হন ব্যবসায়ী নেতা আব্দুস সালাম মুর্শেদী। ওই বছর ২৭ জুলাই মারা যান তৎকালীন এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা। সে সময় সংসদীয় আসনটি ফাঁকা হলে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। উড়ে এসে জুড়ে বসা খেলোয়াড় মুর্শেদী খুলনার মানুষকে বড় স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। খুলনায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির পাশাপাশি বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। এই এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিসহ বেকারত্ব দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সেসব অঙ্গীকার ভুলে যান তিনি। এমপি পদকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন তিনি। আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের স্ত্রীকেও এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করতে নিয়মিত সফরসঙ্গী করতেন। স্ত্রীকে খুলনা-৪ আসনের প্রার্থী করে নিজে ঢাকার কোনো একটি আসন থেকে এমপি নির্বাচন করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তিনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমপি হওয়ার পর খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সদস্য পদ পান আব্দুস সালাম মুর্শেদী। আগে থেকে রাজনীতির মাঠে না থাকায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তাদের ঠেকাতে সুবিধবাদীদের জড়ো করেন এমপি লীগে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। দখল করেন এলাকার মাঠঘাট, জল ও বালুমহাল।

এমপি হওয়ার পর বাড়ে আয় ও অস্বাভাবিক সম্পদ : খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরে সম্পদ বাড়ে ১৮ গুণ। এমপি হওয়ার আগে তার বার্ষিক আয় ছিল ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ৮ কোটি ২ লাখ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে আবদুস সালাম মুর্শেদী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে সম্পদের হিসাব বিবরণীতে এ তথ্য উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে স্ত্রীরও সম্পদ বেড়েছে সমানতালে। তার স্ত্রী শারমিন সালামের কাছে রয়েছে ১৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি টাকা।

সেবা সংঘের নামে অর্থ লোপাট : সংসদীয় এলাকায় সালাম মুর্শেদী সেবা সংঘ এবং শারমিন সালাম ব্ল্যাডব্যাংক ও অক্সিজেন ব্যাংক নামে দুটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন দলীয় লোকজন। এই সংগঠন দুটির আড়ালে করতেন অর্থ আদায়। খুলনার জেলখানা ঘাট এলাকায় ট্রলার চালক সমিতি রয়েছে। এই ঘাটে তার নির্ধারিত কয়েকজন লোক বসানো হয়। যেখান থেকে প্রতিদিন সালাম মুর্শেদী সেবা সংঘের নামে জমা হতো টাকা। একইভাবে জেলখানা ঘাট, রূপসা বাসস্ট্যান্ড ও অটোস্ট্যান্ড থেকে সেবা সংঘের নামে প্রতিদিন টাকা জমা হতো। ৫ বছর ধরেই এই টাকা তার নামে জমা হতো। এসব অর্থ মাস শেষে সালাম মুর্শেদীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হতো।

এদিকে মুর্শেদীর বিরুদ্ধে বড় জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে অসহায় দুস্থদের ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে। ২০২২ সালে রূপসায় রেলের জায়গায় কাবিখা-কাবিটার অর্থে ২৫টি ঘর নির্মাণ করে দেন। অথচ তিনি নিজের টাকায় ওই বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেন। যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন। পরে রেলের আপত্তিতে সেই ঘর সেভাবেই ফেলে রাখা হয়েছে।

নিয়োগ বাণিজ্য ছিল প্রকাশ্য ঘটনা : বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৈরি করেন একক কর্তৃত্ব। সংসদীয় এলাকা তেরখাদা উপজেলার শতদল কলেজের সভাপতি ছিলেন তার স্ত্রী। এই কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগে অন্তত ১৫ লাখ টাকা নেন মুর্শেদীর স্ত্রী। একইভাবে ইন্দুহাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পানতিতা ইসলামিয়া কলেজ ও চিত্রা মহিলা কলেজের সভাপতি ছিলেন শারমিন সালাম। শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে শতবর্ষী অর্ধশত গাছ কেটে ফেলে সেখানে মার্কেট নির্মাণের নির্দেশ দেন এমপি। ওই মার্কেট থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন এমপি। গত পাঁচ বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সব নিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাট করেন সালাম মুর্শেদী ও তার পরিবারের সদস্যরা। রূপসার আলাইপুর কলেজ, রূপসা কলেজের অধ্যক্ষ ও এমএলএসএস পদে নিয়োগ নিয়েও ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। গেল সংসদ নির্বাচনের আগে এমপির নির্দেশে আলাইপুর কলেজের ৫ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় তড়িঘড়ি করে। সেই নিয়োগে প্রায় ৫৫ লাখ টাকার বাণিজ্য করে কলেজটির সভাপতি এসএম হাবীব।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন সালাম মুর্শেদী। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে অন্তত ১১ জনকে নিয়োগ দেন। এসব নিয়োগে ৫-৮ লাখ টাকা করে আদায় করেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতেন তিনি এবং তার স্ত্রী।

সাবেক এমপি সালাম মুর্শেদীর এসব অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে রূপসা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. জাবেদ মল্লিক বলেন, একজন এমপি কতটা নিচু মনের হলে পারাপারের ট্রলার থেকে টাকা নিতে পারে। যেখানে টাকা সেখানে তিনি হাত দিতেন। নিয়োগ বাণিজ্যের পাশাপাশি, বাসস্ট্যান্ড, নছিমন করিমন সমিতি থেকেও টাকা আদায় করতেন তার লোকজন। একই সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর চালাতেন বেপরোয়া নির্যাতন।

খুলনা জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ও রূপসার আইচগাতী ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান বাবুল বলেন, সালাম মুর্শেদী পুরোটাই আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। দলের মধ্যে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। তার স্ত্রী নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে সরকারি বরাদ্দ বিতরণ করতেন। খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগকে ডুবিয়েছেন মুর্শেদী একাই। অভিযোগের বিষয়ে সালাম মুর্শেদী বা তার স্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কারণ মুর্শেদী জেলে। তার স্ত্রী পলাতক। তার ফোন নম্বরও বন্ধ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম