লাইনচ্যুতিতে রেলজুড়ে অনিয়মের চিত্র
রেলের ‘রক্ষাকবচে’ দুর্নীতি ফাঁসছেন প্রকৌশলীরা
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেললাইনের নাট-বল্টু, হুক, ফিসপ্লেট, স্লিপারসহ এসব ছোট যন্ত্রাংশকে রেললাইনের ‘রক্ষাকবচ’ বলা হয়। রেল চলাচলে এই রক্ষাকবচের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ। অথচ এগুলোই এতদিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের মন্ত্রী-সচিব থেকে শুরু করে প্রকৌশলীরা সবাই ছিল মেগা সব প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় রেললাইনে পাথর নেই, লোহার পাতগুলো মরচে পড়ে সরু হয়ে আছে, কোথায় ফিসপ্লেট নেই, নাট-বল্টুগুলো কেউ খুলে নিয়ে গেছে-এসব দেখার যেন কেউ ছিল না। যার ফলে প্রায়ই ঘটেছে এবং ঘটছে ট্রেন লাইনচ্যুতি। এর আগে প্রতিটি লাইনচ্যুতির পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, রিপোর্টও দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এর পর যেই লাউ সেই কদু। গত বৃহস্পতিবার কমলাপুর স্টেশনে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের ৭টি কোচ লাইনচ্যুতির পর গঠিত তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়েই সেই রক্ষাকবচ নিয়ে নিদারুণ অবহেলা আর রেলজুড়ে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ভেসে উঠেছে। এখন দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে নড়েচড়ে বসেছেন খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও রেলসচিব। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে কর্মচারীদের আমলনামা টানা হচ্ছে। ফাঁসতে যাচ্ছে রেল খাতের দুর্নীতিবাজরা।
তথ্য বলছে, প্রায় ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে জরাজীর্ণ লাইনের কারণে। অথচ গত ১৬ বছরে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামী সরকার। ওই সরকারেরই নেওয়া প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ২৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এসব প্রকল্পের মধ্যে জরাজীর্ণ লাইন-সেতু-সিগন্যাল রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নিয়ে কোনো প্রকল্প নেই বললেই চলে! তথ্যে উঠে আসছে রেলে উন্নয়নের নামে মহালুটপাট হয়েছে। গত ১৬ বছরে রেলে ৬ জন মন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। এক-একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। এদের কেউ গ্রেফতার হয়েছে-কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মোট ৩ হাজার ১১৪.৬৬ কিলোমিটার রেলপথের ৮৫ শতাংশই এখন জরাজীর্ণ। এসব লাইনে সংঘটিত দুর্ঘটনার ৮৭ শতাংশই লাইনচ্যুতির কারণে ঘটেছে। বাকি ১৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে লেভেলক্রসিং, দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং ইঞ্জিন ফেল করার কারণে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী রোববার দুপুরে যুগান্তরকে বলেছেন, দেশের সবচেয়ে বড় স্টেশন কমলাপুর। ওই স্টেশনেই বৃহস্পতিবার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। আলোর নিচেই অন্ধকার। উন্নয়নের নমুনা কি এমন ভয়াবহ! জরাজীর্ণ রেলপথে আরও ঝুঁকি রয়েছে। রেললাইন উন্নয়ন-সংস্কার থেকে শুরু করে ছোটখাটো সব ধরনের মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তলব করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তাদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। চলমান লাইন কেন বিপজ্জনক অবস্থায় থাকবে। যাত্রীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি-উন্নয়নের নামে অনিয়ম-দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। আবদুল বাকী বলেন, ‘উপদেষ্টাও কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিটি দুর্ঘটনায় নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। অথচ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে কোনো তদন্ত রিপোর্টই প্রকাশ করা হয়নি। রেল সাধারণ মানুষের বাহন, এ বাহনকে কেন্দ্র করে লুটপাটকারীদের শাস্তি পেতেই হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি অর্থবছরে রেলপথে শুধু পাথর দেওয়ার জন্য প্রায় ২শ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এছাড়া স্লিপার, নাট-বল্টু, হুক, ফিসপ্লেটসহ লাইন সংস্কারে যাবতীয় সরঞ্জাম ক্রয় করতে আরও প্রায় ২শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। রেলের দুই অঞ্চলে সরাসরি রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন দুজন প্রধান প্রকৌশলী এবং একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ)। জরাজীর্ণ লাইন-সেতুর কারণে বছরে প্রায় ১৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়নি। এসব প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো-রাজনৈতিকভাবে।
এক-একজন প্রকৌশলী ১০ থেকে ১২টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করেন। নতুন রেলপথ নির্মাণ থেকে শুরু করে চলমান লাইন সংস্কারের মুখ্য ভূমিকায় থাকেন প্রধান প্রকৌশলীরা।
রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, কমলাপুর থেকে রেললাইন ধরে কয়েকদিন হাঁটলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে-লাইনের করুণ চিত্র। জানা যায়, রেললাইনের সংযোগস্থলে মেটাল লাইনার বসানো হয় প্যান্ডোল ক্লিপের ঠিক নিচে। অর্থাৎ ফিসপ্লেট এবং হুকের দ্বারা লোহার পাতটি স্লিপারের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত করা হয়। এ বিশেষ কাজটি একেবারেই নামমাত্র করা হয়েছে। বছরের পর বছর বিশেষ সরঞ্জামগুলো লাইনে শূন্য থাকলেও তা পূরণ করা হয়নি। অথচ খালি স্থানগুলো পূরণ করতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ-খরচ করা হলেও আসলে লুটপাট হয়েছে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেলপথে কোনো সরঞ্জাম নষ্ট কিংবা ভেঙে গেলে প্রয়োজনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে সংস্কারের পর ট্রেন চালানো। এ আইন কখনোই মানা হয়নি। গত এক যুগে ১৭শ লাইনচ্যুতির ঘটনায় ৬৩৬ জনের প্রাণ গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র এক ট্রেনচালক জানান, একজন চালক কিংবা গার্ড ইচ্ছে করলেও ট্রেন লাইনচ্যুত করতে পারেন না। জরাজীর্ণ লাইন ধরে যুগের পর যুগ ধরে ট্রেন চালাতে হচ্ছে তাদের। অনেক সময় এমন দুর্ঘটনায় তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলীদের শাস্তি দেওয়া হয়নি। ট্রেন চালানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ তো লাইন তৈরি-সংস্কার করে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেলে সবার নজর থাকে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে। কে পিডি হবে, মন্ত্রী-সচিব কাকে পিডি বানাবে, এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। রেলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে-সবই অপরিকল্পিত। চলে প্রকল্পে সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। চলমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ-সংস্কারে কেউ মাথা ঘামায়নি। কারণ এ খাতে বরাদ্দ কম থাকে। নতুন রেলপথ নির্মাণসহ অন্য কোনো প্রকল্পে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। বরাদ্দ বেশি প্রকল্প ঘিরেই সব আয়োজন থাকে রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের। যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে কারও খেয়াল ছিল না।