সিজিএসের সংলাপে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল করে দেওয়া হয়েছিল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৫ বছরে ক্রনি ক্যাপিটাল বা চামচা পুঁজিবাদে রূপ নিয়েছিল দেশ। ডিএনএ টেস্ট (সরকারের সমর্থক) ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স পেত না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল করে দেওয়া হয়েছিল। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কথা বলে গোপনে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পরিসংখ্যানে। এ সময়ে দেশের জনসংখ্যা, জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি, খানা জরিপ এবং রপ্তানি আয়সহ সবকিছুতেই ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এখান থেকে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের এখন নিষ্ঠুর ভালোবাসা দেখানোর সময়। শনিবার রাজধানীর স্থানীয় একটি অডিটোরিয়ামে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত আলোচনা সভায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল-‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ’। ড. দেবপ্রিয়র মতে, কোনো কিছু নিষিদ্ধ করলে তার অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে। কারও রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে তার অর্থনৈতিক অধিকার কমে যায়। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তা ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি- আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির হোসেইন ও মো. জসিম উদ্দিন। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সবাই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। আমরা উপরিকাঠামো নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না। ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, গার্মেন্টকর্মীদের বেতন কত হবে-এসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। তিনি বলেন, এটা স্বাভাবিক কোনো সরকার নয়। মাত্র তিন মাস আগে এই সরকার এসেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা ছেদ হয়েছে। যার কারণে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আলোচনা হওয়া নীতিগুলোই তো দেড় দশক ধরে আলোচনা করে আসছি। সেগুলো দেড় দশকে কেন বাস্তবায়ন হলো না? তাদের কাছে প্রশ্ন, কেন আপনারা বাস্তবায়ন করতে পারলেন না? রাজনীতিবিদরা এখন ব্যবসায়ী আর আমলারা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিগত বছরে জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি, খানা জরিপ, রপ্তানি আয়ের ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করেছে স্বার্থগোষ্ঠীর মাধ্যমে। চুরির ঘটনাও নেওয়া যেত না এলাকার নেতার পারমিশন ছাড়া। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স পেত না। উন্নয়নের কথা বলে টাকা ছাপিয়ে দিল। এ রকম একটা ব্যবস্থার পর নতুন একটা সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। রাতারাতি পরিবর্তন তো আসবে না। ওনার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কোনো নির্বাচনি অঙ্গীকার ছিল না, জবাবদিহিতা ছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। এখনো সুফল না এলেও হয়তো সামনে আসবে। তিনি বলেন, সংস্কারের দুইটা অংশ, একটা জমে থাকা সংস্কার। দ্বিতীয় হলো মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার জন্য। জমে থাকা সংস্কার হলো-যেগুলো আগের সরকারের সংস্কার করা উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়নি। দ্বিতীয় হলো মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার জন্য কী করব। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যদি স্বস্তি না পায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা নির্বাচনে আগানোর দিকে বাধাগ্রস্ত হবো। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাষ্ট্র যখন কুক্ষিগত হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে বড় ভূমিকা যাদের রাখার কথা আপনাদের। কারণ আপনারা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আপনাদের মতো সেই উচ্চবর্গীয় মানুষরা কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন? তিনি আরও বলেন, প্রকৃত মজুরির দিকে লক্ষ্য রাখা এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ করবে আমরা কবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা নির্বাচনের দিকে যাব। তার মতে, সংস্কার নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তা হলো উপরি কাঠামোর আলোচনা। কিন্তু নিচের ভিত্তি হলো অর্থনীতি। অর্থনীতিই নির্ধারণ করবে কীভাবে আমরা সামনে আগাব। তিনি বলেন, আমরা যদি মনে করি অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছে তারাই সব সমাধান করে দিয়ে যাবে বিদেশিদের সহায়তায়। এমন ভ্রান্ত জগতে যদি আমরা বসবাস করি তাহলে বিপ্লব করাটাই তো ভুল হয়ে গেছে। এখানে প্রত্যেকেই যে যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষ করে আমরা উচ্চমর্গের মানুষরা যে ভুল করেছি সেটা যেন আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে সংশোধন করে তুলে ধরতে পারি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে, তাকে তুলে নিতে হবে এসব চলছে। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে। কারও রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে তার অর্থনৈতিক অধিকার কমে যায়।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন-দেড় মাসের আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত ১৮ বছরে দেড় মাসের আন্দোলনের ভিত রচিত হয়েছে। অনেকে রাজনীতি এবং অর্থনীতি আলাদা করে দেখেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ রাজনীতি ঠিক না থাকলে অর্থনীতি ঠিক হওয়ার কথা নয়। তার মতে, বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা দূর করতে হবে। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে সরকারি চাকরি করে ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বেসরকারি খাত। ফলে এ খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই সব সংস্কারে যেতে পারবে না। যতটুকু না করলেই নয়, তাদের সেটুকু করতে হবে। বাকিটা রাজনৈতিক সরকার করবে।
তিনি বলেন, পুরো সংস্কার করতে চাইলে কোনোটাই হবে না। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সমালোচনা করেন তিনি। এই বিএনপি নেতা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তিনি এমন কাজ করছেন, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন সিজিএসের চেয়ার মুনিরা খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহিদুল ইসলাম জাহিদ, বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) ও সাবেক সভাপতি শাহেদুল ইসলাম হেলাল, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ, বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খান এবং ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী প্রমুখ।