বিদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ চিহ্নিত
জব্দের আইনি প্রক্রিয়া শুরু
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করছে সরকার। এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তার সম্পদের তথ্য অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু তথ্য সংগ্রহও হয়েছে। বিদেশের অনেক সম্পদ চিহ্নিতও হয়েছে। এখন সম্পদগুলো জব্দ করার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসাবে যুক্তরাজ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও নীতিনির্ধারকদের সহায়তা নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দেশটির সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে সাইফুজ্জমানের সম্পদ জব্দের আবেদন করা হবে। এজন্য ওই দেশের কোনো আইনি ফার্ম নিয়োগ দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার যুক্তরাজ্যে একটি আইনি ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে টিআইবি এসব তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে সংস্থাটি মন্ত্রীর নাম বলেনি। পরে গণমাধ্যমে এসব তথ্য বেরিয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সম্প্রতি আলজাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশাল সম্পদের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এসব সূত্র ধরে বিএফআইইউ তার সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দেশে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের নামে কোনো সম্পদ থাকলে তা বিএফআইইউকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে দেশ দুটিতে সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদের যেসব তথ্য বিএফআইইউ সংগ্রহ করেছে সেগুলো সরকারের একাধিক সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে বিশদ তদন্তের জন্য। ইতোমধ্যে দেশ দুটিতে পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদভাবে জানানো হয়েছে। এর আলোকে যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে সাইফুজ্জমানের সম্পদ জব্দের আবেদন করা হবে। এ জন্য ওই দেশের কোনো আইনি ফার্মের মাধ্যমে এগোতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাজ্যে একটি আইনি ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হবে। যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের সম্পদ জব্দ করতে হলে সবার আগে সম্পদ চিহ্নিত করতে হবে। সেটি ইতোমধ্যে বহুলাংশে করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত ওই সম্পদ যে বেআইভিাবে অর্জিত হয়েছে, ওই সম্পদের বিপরীতে কোনো কর দেওয়া হয়নি, দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে ওইসব সম্পদ বিদেশে পাচার করা হয়েছে-এর সপক্ষে কোনো সরকারি সংস্থার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। এর আলোকে মামলা দায়ের এবং ওই মামলার বিপরীতে আদালতের আদেশ। ইতোমধ্যে তদন্ত হয়েছে বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তদন্ত করছে। দুদক ইতোমধ্যে মামলা করেছে। এর বিপরীতে তার স্থাবর সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালত আদেশ দিয়েছেন। ওইসব কাগজপত্র আইনি ফার্মের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের আদালতে উপস্থাপন করা হবে। আদালতের মাধ্যমে সম্পদ জব্দের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রক্রিয়াটি একটু দীর্ঘ হলেও এটিই টেকসই হবে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন। জবাবে তারা সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
এখন সরকার যুক্তরাজ্যে একটি আইনি ফার্ম নিয়োগ করবে। এর আগে ওই ফার্ম নিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা হবে। ওই নীতিমালায় ফার্ম নিয়োগ ও তাদের কাজ সম্পর্কে বিশদ উল্লেখ থাকবে। এ কাজের জন্য যেসব দেশ পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে এনেছে তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার উদ্যোগ নেওয়া হয়ছে।
এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আপসানা বেগম সে দেশে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে থাকা সম্পদ জব্দ করতে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি বলেছেন, সম্ভবত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ও নানা ধরনের আর্থিক অপরাধের মাধ্যমে এসব সম্পদ অর্জিত হয়েছে। লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যে সম্পদ আছে, তার মালিকানা বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র ও নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে লড়াই সংগ্রাম করছে, তাতে সহায়তা করতে এই সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
এদিকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনে সম্পদ অর্জন ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্থানীয় কোনো কোম্পানির সহযোগিতা আছে কিনা, সে বিষয়টিও তদন্তের আওতায় আনার কথা হচ্ছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী লন্ডনে একটি বিশাল প্রাসাদে বসবাস করছেন। তিনি এখন ওই বাড়িতেই অবস্থান করছেন। এটির দালিলিক প্রমাণ সরকারের হাতে রয়েছে। আপাতত এ বাড়িটি জব্দ করে সরকারের অনুকূলে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে।
পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে গত সরকারের আমলে পাচার করা টাকা সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। যা বাংলাদেশের পক্ষে যাচ্ছে। ফলে যুক্তরাজ্য সরকারও পাচার করা সম্পদ নিয়ে একটু চাপে আছে। ওই সব সম্পদ দ্রুত জব্দ করা হলে দেশটিরও সুনাম বাড়বে। তবে বাংলাদেশকে সে দেশের আইন মেনে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। আপাতত একজনের পাচার করা টাকা জব্দ করা গেলে এটি অন্য পাচারকারীদের কাছে একটি বার্তা যাবে। যে কারণে সরকার বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এগোচ্ছে।
সূত্র জানায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পিতা ছিলেন আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনিও আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ওই সময়েও তিনি লন্ডনে একটি বাড়ি কেনেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা লন্ডন সফরে গিয়ে ওই বাড়িতে থেকেছেন। এমন কি দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতাও ছিলেন। সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরে আরও টাকা পাচার করে সে দেশে ব্যবসার সাম্রাজ্য আরও বাড়িয়েছেন।
এদিকে যুক্তরাজ্যের ভূমি অফিসের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, দেশটিতে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে ১৫ কোটি পাউন্ড মূল্যের ২৮০টি সম্পত্তি রয়েছে। আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দুবাইতে ২৫০টিরও বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ভূমিমন্ত্রীর। এগুলোর মূল্য ১৪ কোটি ডলারেরও বেশি। তার স্ত্রীও দুবাইতে আরও ৫০টি সম্পত্তির মালিক, যার মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাপী এ দম্পতির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৬০ কোটি ডলারের বেশি।