রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি
ক্ষোভে ফুঁসছে ছাত্র-জনতা
আগামী দুদিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত করা হবে-হাসনাত আব্দুল্লাহ * বঙ্গভবনে নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা, ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, আহত ৫ * কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েত; এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ দফা বাস্তবায়নের দাবি
আসাদুল্লা লায়ন ও মাহাদী হাসান
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করছে বিক্ষোভকারীরা
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে ক্ষোভে ফুঁসছেন ছাত্র-জনতা। এসব দাবিতে মঙ্গলবার বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। রাত ৮টার দিকে বঙ্গভবনের সামনের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন একদল বিক্ষোভকারী। এ সময় তাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের বাধা দিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন তারা। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় পাঁচজন আহত হন।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গভবনের সামনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজির হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বুধ ও বৃহস্পতিবারের মধ্যে আমরা চুপ্পুকে (রাষ্ট্রপতি) অপসারণ করব। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে আসবে। আমরা যদি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবে তা নিশ্চিত না করে চুপ্পুকে অপসারণ করে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করি তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পাবে।
শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি নেই এই সুযোগে তারা যেকোনো সময় আমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। সেজন্য আপনাদের (আন্দোলনকারী) কাছে আহ্বান থাকল আমাদের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবে তা গত ১৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা নির্ধারণ করব। সে পর্যন্ত আমাদের সময় দেওয়ার অনুরোধ করব। এ সময় তিনি আরও বলেন, আমাদের সেনাপ্রধান এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
সেখানে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, রাষ্ট্রপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে কাউকে বসানোর জন্য আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একজনকে নির্ধারণ করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে কথা বলা শুরু করেছি। আরও কয়েক দফা বসতে হবে।
বক্তব্য শেষে ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা চলে যান। পরে আস্তে আস্তে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থানকারী আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কমতে থাকে। রাত ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বঙ্গভবনের সামনে শতাধিক আন্দোলনকারীকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তারা রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের স্লোগান দিচ্ছিলেন।
অন্যদিকে একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণজমায়েত করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেখান থেকে তারা গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান লেখা; ছাত্রলীগকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা; রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে এ সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করাসহ পাঁচ দফা দাবি জানান। আর এসব দাবি বাস্তবায়নে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছেন সমন্বয়করা। রাজধানী ঢাকা ছাড়া একই দাবিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এই কথোপকথন পত্রিকাটির রাজনৈতিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
এ বক্তব্য প্রকাশের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের মধ্যেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দেশের বিভন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রাষ্ট্রপতির মন্তব্য নিয়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা। আর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণসহ চার দফা দাবিতে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি।
এরপর একই দাবিতে বিকাল ৩টার দিকে শাহবাগে মানববন্ধন করে ইনকিলাব মঞ্চ। এরপর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। মানববন্ধন শেষে মিছিল নিয়ে বঙ্গভবন অভিমুখে যাওয়া শুরু করে তারা। মিছিলটি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে শুরু করে মৎস্যভবন, শিক্ষাভবন, সচিবালয়, গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট হয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে শেষ হয়।
পরে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে আলোচনার আশ্বাস পেয়ে কর্মসূচি সমাপ্তির ঘোষণা দিলেও রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। অন্যদিকে মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণজমায়েত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেখান থেকে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। মঙ্গলবার বিকালে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে এ রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে সুপ্রিমকোর্টের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রায় ৪০ মিনিটের মতো প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই উপদেষ্টার এ বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যু এবং রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন তা নিয়ে আলোচনা হয়। দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান বিচারপতি আইজিপি, র্যাব ডিজি ও ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গেও বৈঠক করেন। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি জোরালো হওয়ার পর থেকে সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে আবারও সুপ্রিমকোর্টের মতামত চাইতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন অবস্থায় প্রধান বিচারপতির দুই উপদেষ্টা সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন।
পাঁচ দফা দাবি : গণজমায়েতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন। সেগুলো হলো-বিদ্যমান সংবিধান অবিলম্বে বাতিল করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান লিখতে হবে; ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে এই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে; রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে এই সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করতে হবে; এই সপ্তাহের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের আলোকে ‘প্রোকলেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করতে হবে ও ২০১৪ সাল, ২০১৮ সাল এবং ২০২৪ সালে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এই তিন নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তারা যেন কখনো বাংলাদেশে নির্বাচন করতে না পারেন, সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাসনাত বলেন, ‘ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগসহ ফ্যাসিবাদী সব সংগঠন এবং মুজিববাদী চেতনার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণমাধ্যমকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। ১৭ জুলাই যখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তখনই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, জঙ্গি সংগঠন ও তার মা শেখ হাসিনার এই বাংলাদেশে স্থান হবে না।’
অনলাইনে সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মীদের উদ্দেশ করে হাসনাত বলেন, ‘তোমরা আমাদের কী ভয় দেখাবে? আমরা পুলিশ লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করেছি। তোমাদের ‘মাদার অব টেরর’ শেখ হাসিনা তোমাদের ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য টেনেহিঁচড়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে।’
এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়ে তিনি বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যে যদি আমাদের পাঁচ দফা বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে আমরা আবার রাস্তায় নেমে আসব।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ’৭২ সালের বাকশালী সংবিধান বাতিল করে জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে বসে যদি এই মাসের মধ্যে নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন শুরু না করা হয়, তাহলে নাগরিক কমিটি অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। যারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ফ্যাসিবাদের মূল আদর্শ মুজিববাদিতা। ছাত্রলীগ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রনায়ক ছিল। শেখ হাসিনার সময়ও তারা এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম জারি রেখেছে। বিগত ১৫ বছরে তারা বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। হাজার হাজার মানুষকে গুম করেছিল। ছাত্রলীগ দিয়ে এই ফ্যাসিবাদের শুরু হয়। তাই এদের নিষিদ্ধ করতে হবে। বাকের বলেন, আমরা ৩ তারিখ অঙ্গীকার করেছিলাম, ফ্যাসিবাদের বিলোপ করব এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করব। কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সাহাবুদ্দিন এখনো ক্ষমতায় আছেন।
সমন্বয়ক আরিফ সোহেল বলেন, ’৭২ সালের সংবিধান জনগণের মতামত নিয়ে তৈরি করা হয়নি। সেই ’৭২ সালের সংবিধান রক্ষা করেন বসে থাকা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। তাকে পদত্যাগ করতে হবে। গণজমায়েতে আরও বক্তব্য দেন-সমন্বয়ক সারজিস আলম, লুৎফর রহমান, রিফাত রশীদ, আশরেফা খাতুন প্রমুখ।
গণজমায়েত শেষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে কর্মসূচি শেষ হয়।
২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম : বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। ওই সময়ের মধ্যে মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতির পদ না ছাড়লে ‘দুর্বার আন্দোলন’ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ‘রক্তিম জুলাই-২৪’, ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি’, ‘বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা’, ‘ইনকিলাব মঞ্চ’সহ বিভিন্ন ব্যানারে মঙ্গলবার দুপুর থেকে শিক্ষার্থী ও জনতা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে রাজউকের সামনের মোড়ে অবস্থান নেন। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনের সামনে থেকে ছাত্র-জনতার পক্ষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেন এমদাদ বাবু।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘দোসর’ আখ্যায়িত করে এমদাদ বাবু বলেন, ‘আমরা পরীক্ষিত সৈনিক, সম্মুখযোদ্ধা। আমরা সংগ্রাম করতে গিয়ে হাত-পা-চোখ হারিয়েছি। যদি আরেকটা হাত-পা-চোখ দিতে হয় আমরা তা-ও দিতে প্রস্তুত আছি।’
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পাশাপাশি সংবিধান বাতিল, বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে। এদিকে এ কর্মসূচির কারণে বঙ্গভবন এলাকাজুড়ে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায় সেখানে।
বঙ্গভবনের সামনে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি (স্বারক)। সেখানে তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ ৪ দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘ফ্যাসিবাদের দোসর অবৈধ’ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা; সংবিধান বাতিল করা; বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন করা এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করা।
স্বারকের নাগরিক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ রফিক খান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ একটি সময় রক্তক্ষরণের মাধ্যমে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি; এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা এখনো রাজপথে আছি। স্বৈরাচার আমাদের এই স্বাধীনতাকে বিভিন্নভাবে কলুষিত করার জন্য পাঁয়তারা করে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করছে। তারা একের পর এক অযৌক্তিক দাবি তুলে আমাদের এই রক্তে কেনা স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করছে। এসবের মূল ইন্ধনদাতা খুনি হাসিনার অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি; যে কিনা আমাদের রক্তের ওপর বসে এখনো হোলি খেলছেন। আমরা এটা আর হতে দিতে পারি না।’
আইন উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আসিফ নজরুল স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যারা একাধিক হত্যা মামলার আসামি-তারা কী করে বুক ফুলিয়ে বাইরে চলাফেরা করছে; তারা এখনো চাঁদাবাজি করছে। আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো উপদেষ্টার ওপর যদি স্বৈরাচার ভর করে; তাহলে সেটি হবে চরম থেকে চরম ভুল। ছাত্র-জনতা তাকেও ছেড়ে দেবে না।’
স্বারকের সদস্য মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার রক্ত এখনো শুকায়নি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খুনি হাসিনার অবৈধ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু ১৯৭২ সালের লেখা সংবিধানকে দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার স্বৈরচারিতা দেখিয়েছে, সেই সংবিধানকে পরিবর্তন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ সরকার গঠন করা হয়েছে-এটি একটি বিপ্লবী সরকার, এটি কোনোভাবেই সাংবিধানিক সরকার নয়। বিপ্লবী সরকার হলে বিগত সবকিছুরই পরিবর্তন হবে। গত তিনটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা হলে তখন রাষ্ট্রপতিকেও পদত্যাগ করে বিচারের আওতায় আনা যাবে।’
বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে আহত ৫ : বঙ্গভবনের সামনে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপে পাঁচজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিকও আছেন। মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আহতরা হলেন-শ্যামপুর বহুমুখী স্কূল অ্যান্ড কলেজের ইন্টার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বিশাল (২৪), হকার শফিকুল ইসলাম (৪৫), বার্তা২৪ এর মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার রাজু আহমেদ (২৫), ভিডিও জার্নালিস্ট রিপন রেজা (২৮) ও কুমিল্লা ভিক্টরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ খান (২০)।
আহতদের ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা মেহেদী হাসান বলেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে তারা বঙ্গভবনে ঢুকতে গেলে পুলিশ সদস্যরা বাধা দেন ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়েন। এতে তারা আহত হন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, আহতরা ঢামেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসকের বরাত দিয় তিনি বলেন, তাদের অবস্থা গুরুতর নয়।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি হেফাজত ও এবি পার্টির : রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি)। মঙ্গলবার পৃথকভাবে এই দাবি জানানো হয়। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাবেক অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর কথিত পদত্যাগপত্রের প্রাপ্তির আগে রাষ্ট্রীয় ভাষণে দেশবাসীর সামনে স্বীকার করলেও সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে অস্বীকার করে তিনি স্ববিরোধিতা এবং একই সঙ্গে শপথ ভঙ্গ করেছেন। আমরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিশ্বস্ত এই রাষ্ট্রপতিকে জুলাই বিপ্লবের শত্রু মনে করি এবং তার দ্রুত অপসারণ দাবি করছি।
এদিকে রাজধানীতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেছে আমার বাংলাদেশ পার্টি। দলটি যুগ্ম-সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় শত্রু চিহ্নিত করে ফেলেছে। এ দেশের চিহ্নিত জাতীয় শত্রু হচ্ছে, ভারত ও তার তাঁবেদার আওয়ামী লীগ এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ১৪ দল।
আর খুনি হাসিনার অন্যতম দোসর এই অবৈধ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী চক্রান্ত করার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। এবি যুব পার্টির আহ্বায়ক শাহাদাতুল্লাহ টুটুলের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব হাদিউজ্জামান খোকনের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সিনিয়র সহকারী সদস্য সচিব এবিএম খালিদ হাসান, আব্দুল বাসেত মারজান, মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আলতাফ হোসাইন প্রমুখ।