অবিশ্বাস্য জালিয়াতি ফাঁস
পাসপোর্ট পেতে পরিচয় গোপন করেন ডিবি হারুনও
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মতোই পরিচয় আড়াল করে বেসরকারি পাসপোর্ট নিয়েছেন আলোচিত ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ ওরফে ‘ডিবি হারুন’। নিয়মানুযায়ী তার অফিশিয়াল পাসপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তিনি সাধারণ পাসপোর্ট নেন। জালিয়াতির মাধ্যমে নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেল অফিস থেকে পাসপোর্ট নেন হারুন।
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হারুনের পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্য সামনে আসে। এরপর দ্রুততম সময়ে ঘটনার অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে হারুনের পাসপোর্ট আবেদন সংক্রান্ত সমুদয় কাগজপত্র বিশেষভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়দায়িত্ব নিরূপণের চেষ্টা চলছে। জানা যায়, হারুন অর রশিদ ২০১২ সালে তার পুরোনো পাসপোর্ট বদলে নতুন এমআরপির (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) আবেদন করেন। ১৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার আবেদন জমা করা হয়। এ সময় তিনি পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় আড়াল করে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। কিন্তু যথাযথ যাচাই ছাড়াই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র ৩ দিনের মধ্যে তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। ১৯ এপ্রিল তিনি ৫ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্ট (এসি ৫২৩১৪৬৯) হাতে পান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাসপোর্ট কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ২০১২ সালে বিএনপি নেতা জয়নুল আবদীন ফারুককে পেটানোর ঘটনায় হারুনের নাম দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসে। ঘটনার পরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। পরে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনসাল অফিস থেকে তিনি সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন জমা দেন। এ সময় তিনি নিজের পরিচয় গোপন করেন। আবেদন ফরমে পেশার ঘরে লেখেন অন্যান্য। অর্থাৎ তিনি সরকারি চাকরিজীবী নন।
সূত্র জানায়, সাবেক হুইপ ফারুককে পেটানোর ঘটনায় তিরস্কার বা শাস্তির বদলে তৎকালীন সরকার হারুনকে পুরস্কৃত করে। এমনকি তাকে পুলিশের বীরত্বসূচক পিপিএম পদক দেওয়া হয়। একপর্যায়ে হারুন অনেকটা বীরের বেশে দেশে ফেরেন। এরপর ২০১২ সালে তিনি নতুন করে ফের অফিশিয়াল পাসপোর্টের আবেদন জমা দেন। ২৯ আগস্ট তার নামে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।
সূত্র বলছে, রহস্যজনক কারণে ২০১৭ সালে ফের তিনি অফিশিয়াল পাসপোর্ট বদলে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। তৎকালীন গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) থাকা অবস্থায় তিনি পাসপোর্টের গাজীপুর অফিসে আবেদন জমা দেন। কিন্তু যথাযথ যাচাই ছাড়াই আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। অথচ অফিশিয়াল পাসপোর্ট থেকে সাধারণ বা সাধারণ থেকে অফিশিয়াল পাসপোর্টে রূপান্তরে কড়া বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু হারুনের ক্ষেত্রে এসব নিষেধাজ্ঞা তেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরে সংরক্ষিত হারুনের আবেদন সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গাজীপুরের পুলিশ সুপার থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের ১৮ জুন আরেক দফা সাধারণ পাসপোর্ট হাতে পান হরুন। যার মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই তিনি ফের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট আগারগাঁও বিভাগীয় অফিসে তার আবেদন জমা হয়। এবার তিনি ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন।
সূত্র জানায়, সাধারণ পাসপোর্ট প্রত্যাশী হিসাবে হারুনের আবেদনের সঙ্গে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার স্বাক্ষরিত একটি অনাপত্তিপত্র জমা দেওয়া হয়। পরে অনাপত্তিপত্র যাচাই করে তা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। এ কারণে হারুনের পাসপোর্ট আটকানো হয়নি। ১৭ আগস্ট তাকে নতুন করে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হয়।
ঘটনা প্রসঙ্গে জানার জন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে হারুনের পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যুগান্তরকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবী হলেও যে কেউ সাধারণ পাসপোর্ট নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র দাখিল করতে হয়। হারুনও সাধারণ পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর অনাপত্তিপত্র দাখিল করেন। তাই আইনগতভাবে তার আবেদন আটকে রাখার কোনো সুযোগ ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক একজন মহাপরিচালক যুগান্তরকে বলেন, হরুন যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন, তখনই বিষয়টি গভীরভাবে যাচাই করা উচিত ছিল। এছাড়া পরে তিনি যখন গাজীপুর থেকে তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট নেন, তখনও বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা যেত। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংশ্লিষ্টরা বিষয়গুলো চেপে গেছেন। এ কারণে হারুনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও শনাক্ত করা প্রয়োজন। সরকার পতনের পর থেকেই পুলিশ কর্মকর্তা হারুন আত্মগোপনে রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকবার অজ্ঞাত স্থান থেকে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেও তার মোবাইল ফোন নম্বর অদ্যাবধি বন্ধ। এমনকি ফেসবুকেও তাকে আর সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। পাসপোর্ট আবেদনে জরুরি যোগাযোগের জন্য হারুনের স্ত্রী শিরিন আক্তারের নাম, নম্বর ও কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে হারুনের বক্তব্য জানার জন্য তার স্ত্রীর নম্বরে কল করা হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, বিদেশ যাতায়াতে সুবিধার জন্য সরকারি চাকরিজীবী হয়েও অনেকে পরিচয় গোপন করে সাধারণ পাসপোর্ট নিয়ে থাকেন। কারণ, অফিশিয়াল পাসপোর্টে বিদেশ যেতে সরকারি চাকরিজীবীদের দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। বিদেশ ভ্রমণের আগে তাদের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময়ও অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের বিশেষ পুলিশি যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সাধারণ পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রে এসব ঝামেলার কোনো বালাই নেই। সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা থাকলেই সাধারণ পাসপোর্টধারীরা অনেকটা বাধাহীনভাবে বিদেশ যাতায়াত করতে পারেন।