Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপ

নির্বাচনি রোডম্যাপে গুরুত্ব

নেতাদের প্রস্তাব প্রধান প্রধান সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে * আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাজার সিন্ডিকেট ও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে জোর

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনি রোডম্যাপে গুরুত্ব

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ চেয়েছে। তারা বলেন, প্রধান প্রধান সংস্কারগুলো জনগণের নির্বাচিত সরকার করবে। সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে নেতারা বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় জনগণ। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বাজার সিন্ডিকেট ও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংলাপে জোর দেন বিভিন্ন দলের নেতারা। গণতন্ত্র ও গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে সংলাপে। এছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ গত ১৫ বছরে নেতাকর্মীদের নামে রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহার চেয়েছেন তারা। প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সরানোর ওপরও জোর দিয়েছেন সংলাপে অংশ নেওয়া নেতারা।

শনিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এসব কথা বলেন। দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় এ সংলাপ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর আগে ৫ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতসহ পাঁচটি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে সংলাপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। শনিবার বেলা ৩টায় প্রথমে গণফোরামের সঙ্গে শুরু হয় সংলাপ। রাতে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংলাপ শেষ হয়। এছাড়াও এদিন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, জাতীয় গণফ্রন্ট, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশে লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাসদের (একাংশ) শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে নিজ নিজ দলের পক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। এ সময় সংবিধান, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ড. কামাল হোসেন কথা বলেন। দলটির সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, সংলাপে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি। সিন্ডিকেট অবশ্যই ভাঙতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। এ অবস্থা থেকে দেশ উদ্ধারের জন্য আমাদের জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

সংলাপে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে মোস্তফা মহসীন বলেন-অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন করতে হবে। রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি, সংস্কার শেষ দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য।’ সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে লিখিত আকারে প্রস্তাব দেব। জাতীয় দিবস ছাড়া কোনো দিবসই রাখা উচিত নয়। সংলাপে গণফোরামের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন, কো-চেয়ারম্যান এসএম আলতাফ হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, সদস্য একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিউদ্দিন আবদুল কাদের, মোশতাক আহমেদ ও সুরাইয়া বেগম।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকালে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আলোচনা করেছি এবং লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। প্রথমবার যখন এসেছি, তখন ১০৩টা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আজ আরও ২৩টা প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের দল কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বা কাউকে জেল থেকে মুক্তির জন্য কোনো প্রস্তাব দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণের যা প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন, সুন্দর প্রশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষ কষ্ট পাচ্ছে-এ পয়েন্টগুলো আমরা দিয়েছি।’ এলডিপির প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘সংস্কার কমিশন গঠন করলে হবে না, কমিশনকে রূপরেখা তৈরির দায়িত্ব দিতে হবে। এই রূপরেখা তৈরি করার পরে পুরো বাংলাদেশের যারা যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নতুন করে খসড়া তৈরি করবে। খসড়া শেষে তারা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করবেন। এলডিপির এই নেতা বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে আমাদের বহু ছেলেমেয়ে হতাহত হয়েছে। দেড় হাজারের ওপরে আমাদের ছেলেমেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন।’ ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে অলি আহমদ বলেন, ‘জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেদিন আমরা তাদের নিষিদ্ধ করেছিলাম। আওয়ামী লীগ ১৮ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নূরুল আলম তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, সংস্কার সংস্কারের মতো করে চলবে। সরকারকে এর মধ্যে একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ দিতে বলেছি। সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার দাবি জানানো হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে বৈঠক আলোচনা হয়েছে। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে তার টিম দিয়ে বাজার মনিটরিং করার পরামর্শ দিয়েছি। সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বলেছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে বৈঠকে। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কারের মালিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। সংবিধানের মেজর পরিবর্তন করবে নির্বাচিত সরকার। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালকদের আইনের আওতায় আনার দাবিও জানান সমমনা জোটের শীর্ষ নেতারা।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমরা বলেছি যত সংস্কার করুক না কেন, সবার আগে সংস্কার করতে হবে উপদেষ্টা পরিষদের। এ পরিষদের হাতেগোনা কয়েকজনের সফলতা ছাড়া বাকি সবাই ব্যর্থ। তাই ব্যর্থদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, নাকি নিষিদ্ধ করা হবে সেটা মুখ্য না। একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ হবে নাকি হাইকোর্ট থেকে কোনো আদেশের মাধ্যমে হবে সেটি পরের ব্যাপার কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা আরম্ভ হওয়া উচিত। পার্থ বলেন, আমি বলেছি আপনার এমন কোনো সংস্কারে হাতে নেবেন না যেটা গণতান্ত্রিক সরকারের নেওয়া উচিত। আপনাদের সংস্কারগুলো নির্বাচনমুখী সংস্কার হলে ভালো হবে। বাকি প্রস্তাব থাকতেই পারে, যেগুলো হয়তো পরবর্তী সরকার করবে।

১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের যেসব প্রেতাত্মা এখনো প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে আছে তাদের আমরা অপসারণ করতে বলেছি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছি। ভর্তুকি দিয়ে হলেও অবিলম্বে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করা প্রয়োজন তিনি সেই পদক্ষেপ নেবেন। জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে এনে সুশাসন কায়েম করতে হবে। আমরা সংস্কারের বিষয়ে একমত পোষণ করেছি। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করে তৃণমূল থেকে স্বৈরাচারকে উৎখাতের কথা বলেছি। সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি। সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে গঠিত সরকারকে এখন বিপ্লবী আচরণ করতে হবে, ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন করতে হবে। যেসব দল ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সংলাপে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে ১৪ দফা লিখিত প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। দলটির চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, সংলাপে সংস্কারসহ একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) আমাদের কাছ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা চেয়েছিলেন। প্রথম নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে আমরা বলেছি ২০২৫ সালের জুনের পরে সহজেই নির্বাচন দেওয়া সম্ভব এবং তাদের সেভাবে চেষ্টা করা প্রয়োজন। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে আমাদের নিয়মিত আলোচনায় থাকবেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম