যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ শেষ
মুক্তি মেলেনি নিরপরাধ বাদল ফরাজীর
ভারতে গিয়ে নামের মিলে ফেঁসে যান খুনের মামলায় * জেলে বসেই মাস্টার্স পাশ করেন, শিখেছেন ইংরেজি, হিন্দি ভাষাও
বাদল ফরাজী
ভারতে ১৮ বছর বয়সে তাজমহল দেখতে গিয়ে নামের মিলে হত্যা মামলার আসামি হয়ে যান বাদল ফরাজী। সেখানকার আদালতে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। নির্দোষ জানতে পেরে বাংলাদেশ সরকার বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তাকে দেশে আনে। বাদল ফরাজীর বয়স এখন ৩৫ বছর। তিনি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। তার কয়েদি নং ৫০০২/এ। আদালতের দেওয়া সাজার মেয়াদ শেষের পর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মুক্তি পাননি বাদল। ভারতের কারাগারে বসে উচ্চশিক্ষিত হওয়া বাদল ফরাজীর এখন কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দিন কাটছে বন্দিদের লেখাপড়া, খেলাধুলা শেখানো এবং সংশোধনের ছবক দিয়ে। অন্যদিকে ছেলের শোকে বহু আগেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বাবা। আর বৃদ্ধ মা এখনো অপেক্ষায় আছেন তার নির্দোষ ছেলে কবে ফিরবে তার কাছে।
জানা গেছে, বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের কাছে টি এ ফারুক স্কুলসংলগ্ন মোর্শেদ সড়কে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন বাদল ফরাজী। তার বাবা আবদুল খালেক ফরাজী। মা শেফালি বেগম। টি এ ফারুক স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পাশ বাদল বাবার সঙ্গে মেকানিকের কাজ করতেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল তাজমহল দেখার। সেই ইচ্ছা পূরণে ভিসা নিয়ে ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা দেন বাদল। ওইদিন দুপুরে বেনাপোল ইমিগ্রেশন কার্যালয়ে সব প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতের হরিদাসপুর সীমান্তে প্রবেশের পরই তাকে আটক করে বিএসএফ। তার ভারত যাওয়ার আগেই দিল্লির অমর কলোনিতে ২০০৮ সালের ৬ মে এক বৃদ্ধাকে খুন করে তার দুই কাজের লোক। তাদের একজনের নাম বাদল সিং। সেই বাদল সিংকে ধরতে ভারতীয় পুলিশ সীমান্তেও সতর্কতা জারি করে। এদিকে বাদল ফরাজীকে পেয়ে বিএসএফ সেই আসামি বাদল সিং মনে করে। বাদল বাংলা ছাড়া হিন্দি, ইংরেজি কোনো ভাষা জানতেন না। আর বিএসএফ সদস্যরা তার বাংলা বুঝেননি। যে কারণে বিএসএফ সদস্যদের বোঝাতে ব্যর্থ হন অভিযুক্ত যেই বাদল সিংকে খোঁজা হচ্ছে, তিনি সেই বাদল নন। এরপর তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। পরে ওই খুনের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয় বাদলের বিরুদ্ধে। তাকে নেওয়া হয় ভারতের তিহার কারাগারে। বাদল কারাগারে বসে লেখাপড়া শুরু করেন। এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কারাগারে বসেই। শেখেন ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা। তিহার কারাগারে বন্দিদের তিনি ইংরেজি শেখাতে শুরু করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে আটটি ডিপ্লোমা কোর্সও করেন বাদল। আর আদরের ছেলের হদিস না পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান বাদলের বাবা আব্দুল খালেক।
এদিকে ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট ওই হত্যা মামলায় বাদল ফরাজীকে দিল্লির সাকেত আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আপিল করা হলেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। রায়ের পর থেকে তিহার জেলের ৩ নম্বর সেলে কেটেছে তার দিন। একদিন তিহার কারাগারে বন্দিদের কাউন্সেলিং করতে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী রাহুল কাপুরের সঙ্গে কথা হয় বাদলের। সব শুনে রাহুল তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। তিনি ‘জাস্টিস ফর বাদল’ শীর্ষক একটি আবেদনে স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাদলের দণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। এ নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। রাহুল বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করলে হাইকমিশন সরকারের কাছে চিঠি পাঠায়। এরপরই বাদলকে ছাড়াতে চিঠি চালাচালি শুরু হয় দুই দেশে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভার প্রস্তাবে বাদলকে নির্দোষ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়। প্রায় ১০ বছর ভারতে কারাবাসের পর বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল বাদল ফরাজীকে দিল্লি থেকে ঢাকায় এনে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখে। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী এক দেশের বন্দি আরেক দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পর সাজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে রাখতে হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ভারতীয় পেনাল কোড অনুযায়ী বাদলের সাজা হয়েছে ১৪ বছরের। আর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর। তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশেও ১৪ বছর ছিল। বাদলের ক্ষেত্রে যেহেতু তার ভারতীয় আইনে সাজা হয়েছে, ভারতীয় আইনেই সাজা কাউন্ট হওয়ার কথা। এ হিসাবে বাদলের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ২০ জুলাই। ওই বছরের আগস্টে বাদলের মুক্তির বিষয়ে ভারতীয় সরকারের অনুমোদনের জন্য একটি চিঠি পাঠানো হয়। এরপর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে কোনো অনুমোদন আসেনি। ফলে বিনা অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত বাদল ফরাজীকে আরও অতিরিক্ত কারাভোগ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে অন্তত পাঁচবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর আসছে না। ভারতের অনুমতি ছাড়া তাকে মুক্তিও দেওয়া যাচ্ছে না। বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী এক বন্দিকে আরেক দেশে মুক্তি দিতে হলে যে দেশের আদালত রায় দিয়েছেন, সেই দেশের অনুমোদন লাগে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) সুরাইয়া বেগম যুগান্তরকে বলেন, তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে আমরা কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। তিনি বলেন, বন্দি বিনিময় চুক্তিতে আসা বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে যে দেশে সাজা হয়, সেই দেশের আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন হয়।
এদিকে বাদল ফরাজীকে আইনি সহায়তাদানকারী অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন জুয়েল যুগান্তরকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি তাকে মুক্ত করার। কিন্তু জটিলতার কারণে মুক্ত করা যাচ্ছে না। তিনি জানান, ভারতের আদালতের রায়ে বাদলের ৫ হাজার রুপি জরিমানা হয়েছিল। সেই জরিমানার রুপি কোন মারফত কীভাবে প্রদান করতে হবে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ থেকে চিঠি লেখা হয়েছে বহু আগে। কিন্তু কোনো উত্তর আসছে না।
বাদল ফরাজীর মা বৃদ্ধ শেফালী বেগম যুগান্তরকে বলেন, বাদলরা ৫ ভাই-বোন। বাদলের শোকে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এখন বড় মেয়ে আকলিমাই সংসারের দেখাশোনা করে। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আল্লাহ যেন আমার ছেলেটাকে মুক্ত করে দেন, এটাই চাওয়া। এছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই।