চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি
শাহবাগে অবরোধ আউটসোর্সিং কর্মীদের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আউটসোর্সিং কর্মীরা। শনিবার সকাল ১০টার দিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শাহবাগে এসে রাস্তা অবরোধের কারণে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এতে সরকারি ছুটির দিনেও বেসরকারি অফিসগামী মানুষসহ রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সরকারের আশ্বাসে প্রায় ৭ ঘণ্টা পর বিকাল ৫টার দিকে আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছেড়ে চলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে ১৫ দিনের মধ্যে দাবির সুরাহা করা না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আশপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
আন্দোলনকারী নেতারা বলেন, সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর, অধিদপ্তরের সব প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিং প্রকল্পে কর্মরতদের চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যে কোনো সময় তাদের চাকরি চলে যেতে পারে। কাজ না করলে তারা বেতনও পান না। কোনো ঈদে বোনাস দেওয়া হয় না। কেউ কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাকরিচ্যুত করে, নয়তো বেশি বেশি ওভারটাইম করিয়ে শাস্তি দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে সারা দেশ থেকে আউটসোর্সিং কর্মীরা একদফা দাবি বাস্তবায়নে শাহবাগে জড়ো হয়েছেন। দাবি না মানলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের ব্যানারে কয়েক হাজার কর্মচারী সকাল ১০টার দিকে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন। তারা রাস্তার সব পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে শাহবাগসহ আশপাশের সব সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। বেসরকারি চাকরিজীবী, গণপরিবহণের যাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল (বারডেম), ঢাকা মেডিকেলসহ আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। রাস্তা বন্ধের কারণে অ্যাম্বুলেন্স ও রোগীবাহী রিকশা, সিএনজি অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনকেও রাস্তা ঘুরে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। বিকাল ৫টার পর আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছেড়ে চলে গেলে যান চলাচল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
মিরপুর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসা উম্মে সালমা জানান, তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ। শনিবার ছুটির দিন রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় বারডেমের উদ্দেশে আসেন। কিন্তু শাহবাগে রাস্তা বন্ধ থাকায় তারা কাওরান বাজারেই নেমে যেতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, কয়েকদিন পর পর রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষরা সব থেকে বেশি ভোগান্তির শিকার হন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না।
পল্টনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রুহুল আমিন বলেন, মোহাম্মদপুর থেকে ঠিকমতো এলেও শাহবাগ মোড়ে এসে আটকা পড়েন। ২০ মিনিটের মতো অপেক্ষার পর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেন। তার মতে, মানুষের আন্দোলন করার অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে অন্যের অধিকার কেন ক্ষুণ্ন করা হবে? স্ত্রীকে নিয়ে বিএসএমএমইউতে এসেছেন খুলনার হোসেন। তিনি বলেন, রাস্তা বন্ধের কারণে পল্টন থেকে রিকশায় উলটো রাস্তায় কিছুটা এসে বাকি পথ হেঁটে হাসপাতালে যান। কেউ যেন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করতে না পারে, সেজন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
আব্দুর রাকিব সনেট নামে এক সংগঠক যুগান্তরকে বলেন, জনগণের সেবা প্রদানের জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এটি আউটসোর্সিং নীতিমালা ২০১৮-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা একটি কালো আইন। এই কালো আইনের দ্বারা সরকার এবং কর্মরতদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডার ব্যবসার মাধ্যমে মূল্যবান অর্থ আত্মসাৎ করে যাচ্ছে। জনবল সরবরাহের নামে তারা কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাই সরকারি অর্থ অপচয় না করে আউটসোর্সিং নীতিমালা বাতিল এবং এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করে রাজস্বভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
আরেক সংগঠক দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাজস্বকরণে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে না। প্রতি মাসে যে পরিমাণ টাকা ঠিকাদারকে দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ হলেই সরকারের সঞ্চয় হবে, যার আসল ও লভ্যাংশ থেকে রাজস্বকৃতদের অতিরিক্ত যাবতীয় ব্যয় বহন করা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে সুরাহা না করায় তারা রাজপথে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একটি মিছিল নিয়ে আউটসোর্সিং কর্মীরা শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা মোড়ের সব পয়েন্ট বন্ধ করে অবরোধ শুরু করেন। রাস্তা বন্ধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মৎস্যভবন, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, বাংলামোটরসহ আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তারা ‘স্বাধীন বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘ছাত্র-জনতার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘দাসপ্রথা বিলুপ্ত চাই’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান দেন।
দেখা যায়, শাহবাগের চারপাশে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘিরে রাখে পুলিশ। কোনো ধরনের ঝামেলা না করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে বলেন। এর মধ্যে দুপুরের দিকে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানকার কর্মকর্তারা দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। দেখা যায়, বিকালের দিকে এক সমন্বয়ক মাইকে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কর্মকর্তারা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে ১৫ দিনের মধ্যে দাবি মেনে নেওয়া না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। ঘোষণার পর ধীরে ধীরে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ ছেড়ে চলে যান।
শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, সকাল থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আউটসোর্সিং কর্মীরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগ এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করলে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকাল ৫টার দিকে তারা রাস্তা ছেড়ে চলে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।