Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

নজিবুরের নজিরবিহীন দুর্নীতি

সোর্স মানি লোপাটের ফাইল গায়েব

Icon

সাদ্দাম হোসেন ইমরান

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সোর্স মানি লোপাটের ফাইল গায়েব

সাবেক মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে করিৎকর্মা ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব হিসাবে বদলির সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র, ফাইল নিয়ে যান। এগুলোর মধ্যে সোর্স মানির ফাইলও ছিল। তাই চাকরিকালীন সময়ে কী পরিমাণ অর্থ সোর্স মানি হিসাবে লোপাট করেছেন তার সঠিক তথ্য এনবিআরের কাছে নেই। তবে ওই সময়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ও শুল্ক গোয়েন্দায় কর্মরত কর্মকর্তাদের ধারণা, সোর্স মানির পরিমাণ হবে ৫-১০ কোটি টাকা। 

সাধারণত কর ফাঁকির অভিযোগ প্রাপ্তি এবং সেই সংবাদের ভিত্তিতে কর ফাঁকি উদ্ঘাটিত হলে সংবাদদাতাকে সোর্স মানি দেওয়া হয়। প্রতিবছর এনবিআরের খরচের একটি অংশ সোর্স মানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়। অন্য সব ব্যয়ের অডিট হলেও সোর্স মানি ব্যয়ের কোনো অডিট হয় না। সিআইসি সোর্স মানি এনবিআরের বোর্ড প্রশাসন শাখা এবং শুল্ক গোয়েন্দার সোর্স মানি শুল্ক গোয়েন্দার বাজেট থেকে নির্বাহ করা হয়। এই দুই দপ্তরে ২০১৫-১৮ মেয়াদে সোর্স মানির ফাইল অনুসন্ধান করেও পাওয়া যায়নি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নজিবুর রহমান মুখ্য সচিব হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক হন ড. সহিদুল ইসলাম। ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল তিনি শুল্ক গোয়েন্দায় তার আগে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তার কাছে সোর্স মানির ফাইল ও রেজিস্ট্রার বিষয়ে জানতে চান। দুদফা চিঠি দেওয়ার পর আগের মহাপরিচালক চিঠি দিয়ে জানান, সোর্স মানি সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি অডিটযোগ্য নয়। যেহেতু এ সংক্রান্ত বরাদ্দকৃত অর্থ অডিটযোগ্য নয়, তাই কোনো হিসাব ও রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক নয়। চিঠিতে আগের মহাপরিচালক (নজিবুর রহমানের আমলে দায়িত্বপ্রাপ্ত) উলে­খ করেন, গোয়েন্দা তথ্যাদি অত্যন্ত গোপনীয় এবং সোর্সদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগও স্পর্শকাতর। এর সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত বিধায় তাদের তথ্যসংক্রান্ত কোনো দাপ্তরিক নথি সংরক্ষণ ও এর ধারাবাহিক সূত্র চাওয়ার প্রশ্নটি আসছে না। অডিট ম্যানুয়াল, তথ্য অধিকার আইন ও অন্য দপ্তরের প্রথা অনুসারেও তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। 

দুই কমিশনারের চিঠি চালাচালির বিষয়টি রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত গড়ায়। পরে এনবিআর চিঠি দিয়ে আগের মহাপরিচালককে জানায়, তথ্য অধিকার আইনে কোনো দপ্তরের প্রধানকে এক দপ্তর হতে বদলি হয়ে অন্য দপ্তরে চলে যাওয়ার সময় সরকারি নথি ও রেজিস্ট্রার ব্যক্তিগত হেফাজতে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সচিবালয় নির্দেশিকাতেও এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে বদলি হয়ে যাওয়ার সময় পূর্বের দপ্তরের সরকারি নথি নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দপ্তর প্রধানকে দেওয়া হয়নি। সব সরকারি নথি ও রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রক্ষিত থাকবে, এটিই বিধান। এর প্রেক্ষিতে ৩ দিন সময় বেঁধে দিয়ে তাকে সব নথি ও রেজিস্ট্রার শুল্ক গোয়েন্দায় ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোর্স মানির এ বিষয়ে দুই কমিশনারের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে কর্মরত তৎকালীন মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের চাপে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এ বিষয়টি মীমাংসা করে দেন এবং ড. সহিদুলকে ফাইলের বিষয়ে আর খোঁজ না করতে নির্দেশ দেন। সেই ফাইল পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

বোর্ড প্রশাসন শাখাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালে সেগুনবাগিচা থেকে রাজস্ব ভবন স্থানান্তরের সময়ে অনেক পুরাতন ফাইল নিখোঁজ হয়ে যায়। আর নজিবুর রহমানের এই দুই শাখায় কর্মরতদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মুখ্য সচিব হিসাবে নিয়োগের পূর্বে অফিস ত্যাগের সময় নজিবুর রহমান সোর্স মানিসংক্রান্ত ফাইল তৎকালীন পিএসের মাধ্যমে তলব করে নিয়ে গেছেন। তৎকালীন ডিজিই তাকে সব ফাইল বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোর্স মানি লুটের টাকা বৈধ করতে ‘প্রটোকল ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক শিষ্ঠাচার’ নামের একটি বই লেখেন নজিবুর রহমান। তাকে এ পরামর্শ দেন তৎকালীন সিআইসির ডিজি বেলাল উদ্দিন। এনবিআরের অধীন কর অঞ্চল, রেঞ্জ ও সার্কেলসহ মোট ৮০৮টি অফিসে এবং ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের মোট ৫৯৬টি অফিসে ন্যূনতম ১০টি করে বই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিনতে বাধ্য করেন। যার ত ত্ত্বাবধান করেন বেলাল উদ্দিন। আনুকূল্য পাওয়ার জন্য অনেক আয়কর ও কাস্টমস কমিশনার সরকারি ফান্ড থেকে নজিবুর রহমানের বই কেনেন। এই প্রক্রিয়ায় বই বিক্রির সম্মানি বাবদ ৮ কোটি টাকা বৈধ করেন তিনি। এরপর একই কায়দায় তার স্ত্রীর লেখা বইও বিক্রি করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, নজিবুর রহমানের আবদার, ফরমায়েশ পূরণে প্রধানতম হাতিয়ার ছিল ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প। এ প্রকল্পের অর্থে তিনি সপরিবারে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এ কারণে ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান শতাধিক কর্মকর্তার ভিয়েতনামে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাতিল করে। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রকল্পের টাকায় মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেল থেকে অফিস এবং বাসায় কমপক্ষে ১০টি নাস্তার প্যাকেট পাঠানো হতো। যার প্রতিটির মূল্য ৮০০ টাকা করে। দুপুরে কস্তুরী হোটেল থেকে অফিসে ও বাসায় খাবার যেত। উৎসব-পার্বণে সোনারগাঁও হোটেল থেকে খাবার আনা হতো এবং সেই খাবার বাসায়ও পাঠানো হতো। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ভয়ে এ অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবাদ করারও সাহস পাননি। এসব খরচ প্রকল্পের ফাইলে রক্ষিত আছে বলে দাবি করেন তিনি।

নজিবুর রহমান আটকের পর অনেক কর্মকর্তা তার অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, নজিবুর রহমানের লেজুড়বৃত্তি না করায় অনেক যোগ্য কর্মকর্তার সঠিক সময়ে পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতির ফাইল আটকে রাখেন। অথচ সিআইসির তৎকালীন মহাপরিচালকের এসিআরে সাবেক অর্থমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট বিরূপ মন্তব্য থাকলেও তাকে এসএসবি সভায় পদোন্নতি প্রদানের জন্য প্রভাব বিস্তার করেন। অনেক ক্ষেত্রেই বহু কর্মকর্তার এসিআর অর্থমন্ত্রীর কাছে না পাঠিয়ে শুধু ফরোয়ার্ডিং (অগ্রায়নপত্র) পাঠাতেন। পরে সেসব কর্মকর্তার এসিআর খুঁজে না পাওয়ায় পদোন্নতি এবং সার্ভিস রেকর্ড সংরক্ষণে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তার এসিআরে নিজের খেয়াল-খুশিমতো বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে এসব কর্মকর্তা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিরূপ মন্তব্যের কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া নজিবুরের ফরমায়েশ খাটতে অপারগতা প্রকাশ করায় বহু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য শৃঙ্খলামূলক বিভাগীয় মামলা চালু করেন তিনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম