নজিবুর রহমানের নজিরবিহীন দুর্নীতি
ছেলের নামে কেনেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট
পূর্বাচলে প্লট, নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন * সিআইসি থেকে সোর্স মানির নামে টাকা লুটেছেন দুহাতে
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাবেক মুখ্যসচিব নজিবুর রহমানের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মহাকাব্য আরব্য উপন্যাসকেও হার মানাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থাকাকালীন ব্যবসায়ী ও কাস্টমস-আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
পূর্বাচলে প্লট, সুস্থ ছেলেকে প্রতিবন্ধী কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পরবর্তী সময়ে ওই ছেলে বেকার থাকাবস্থায় রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে এবং আমেরিকায় বড় ছেলের উচ্চশিক্ষার ব্যয়নির্বাহের নামে বিদেশে অর্থ পাচারও করেছেন। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের টাকায় সপরিবারে দেশবিদেশ ঘুরেছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) থেকে সোর্স মানির নামে টাকা লুটেছেন দুহাতে।
এ সবকিছু জায়েজ করেছেন পাঠ অযোগ্য বই বিক্রির নামে। স্বনামধন্য লেখকদের বই যেখানে কোটি টাকা বিক্রি হয় না, সেখানে তিনি ৮ কোটি টাকার বই বিক্রির সম্মানি দেখিয়ে অবৈধ আয় বৈধ করেছেন। শুধু তাই নয়, সরকারি অর্থের অপচয়ের ক্ষেত্রে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
আগারগাঁও রাজস্ব ভবন নির্মাণে একগুঁয়েমির কারণে সরকারের ৬০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে তৎকালীন সিআইসি মহাপরিচালক বেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে হয়রানি করা হতো। আর মুখ্যসচিব থাকাবস্থায় জড়ান শেয়ারবাজারের প্লেসমেন্ট কেলেঙ্কারিতে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পূর্বাচলে (প্লট-১৬, রোড-৪০১/১, সেক্টর-০৯) ঝর্ণাধারা নামে একটি প্লট আছে। মুখ্যসচিব থাকাবস্থায় প্লটটি নেন তিনি। এছাড়া রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বিপরীতে রূপায়ণ স্বপ্ননিলয় কন্ডোমিনিয়াম প্রজেক্টে ৫ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট (এফ-২) আছে। এই ফ্ল্যাটের মালিক নজিবুর রহমানের ছোট ছেলে ফারাবি এনএ রহমান।
ছেলের নামে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। বাজারদরের চেয়ে কম দামে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন একসময়ে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই প্রধান কর্তা। বড় ছেলের অপরাধ ঢাকতে আরও উদার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন নজিবুর রহমান। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে ইকোনমিক মিনিস্টার হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে ফুয়াদ এন রহমানকে একটি স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান।
পরবর্তী সময়ে ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে। এ কারণে ফুয়াদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। এছাড়া নজিবুর রহমান তার ছেলে ফুয়াদকে স্থানীয় স্টাফ হিসাবে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসুলেটে ২০১৫-১৬ সালে প্রভাব খাটিয়ে চাকরি দেন। মাসে দেড় হাজার ডলার বেতন নিলেও ফুয়াদ মিশনে কোনো কাজ করেননি।
২০১৫ সালে পরিবেশ ও বন সচিব থেকে নজিবুর রহমানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার পর আরও বেপরোয়া তিনি। এনবিআরে নিয়োগ পাওয়ার পর সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ শুরু করেন। ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। প্রকাশ্য মিটিংয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অপমানসূচক আচরণ করতেন তিনি।
নিজস্ব স্টাইলে কর্মকর্তাদের লাল, হলুদ ও সবুজ মার্কিং করতেন। যেসব কর্মকর্তা তার অনৈতিক আবদার রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, তাদের লাল ক্যাটাগরির কর্মকর্তা হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে ডাম্পিং পোস্টিং দিতেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বর্তমানে শুল্কনীতির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা হোসেন আহমেদ। ক্ষমতায় থাকাকালে চট্টগ্রাম কাস্টমসে এক ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার জন্য তৎকালীন কমিশনার হোসেন আহমেদের কাছে তদবির করেন নজিবুর রহমান। সেই তদবির রক্ষা করতে না পারায় এ সৎ কর্মকর্তার ওপর খড়্গ নেমে আসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নজিবুর রহমান এনবিআর চেয়ারম্যান থাকাকালে ‘প্রটোকল ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার’ নামে একটি বই লিখেন। মূলত ঘুস গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত আয় বৈধ করতে বই লেখার ফন্দি আঁটেন। মাঠ পর্যায়ে কর অফিস, ভ্যাট অফিস, একাডেমিতে পাঠিয়ে জোরপূর্বক বই কিনতে বাধ্য করেন। এ বই বিনামূল্যে ছাপিয়ে দেন তৎকালীন কাস্টমসের এক কমিশনার।
পুরস্কারস্বরূপ তাকে কাস্টমসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়। আর বই বিপণনের দায়িত্ব পালন করেন সিআইসির তৎকালীন ডিজি বেলাল উদ্দিন। বই বিক্রির সম্মানি বাবদ তার ট্যাক্স ফাইলে ৮ কোটি টাকা বৈধ করা হয়। একই কায়দায় নিজ স্ত্রী নাজমা রহমানের নামে লেখা বইও জোরপূর্বক মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে কেনানো হয়। সেখান থেকেও মোটা অঙ্কের অবৈধ অর্থ বৈধ করা হয়।
ভোগবিলাস, গোঁয়ারতুমিতে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় : এনবিআর চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় রাজস্ব আদায়ের চেয়ে নিজ ভোগবিলাসে মত্ত থাকতেন নজিবুর রহমান। মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবন সাজানোর জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। কাজ না হওয়ায় বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেট থেকে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তার বাসভবনের পর্দা, আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এমনকি তার বাসভবনে মনিটরসহ ১০টি সার্ভিলেন্স ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এসব ক্যামেরার বিল হিসাবে সাড়ে ৩ লাখ টাকা এনবিআর থেকে দেওয়া হয়। বাসার প্রত্যহিক খাবার খরচও এনবিআর থেকে দেওয়া হতো।
অন্যদিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবন নির্মাণে গোঁয়ারতুমির কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। ২০০৮ সালে ২০তলা ভিতের ওপর ১২ তলা রাজস্ব ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
নজিবুর রহমান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে রাজস্ব ভবন প্রকল্পের কাজের পরিধি ব্যাপক পরিবর্তন করে ৩০ তলা ভিতের ওপর ১২ তলা ভবন নির্মাণের আদেশ দেন। তার খেয়ালখুশিমতো এবং স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পের ব্যয় ২৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা একনেক সভায় নাকচ হয়ে যায়। কিন্তু ৩০ তলা ভিতের ওপর ভবন নির্মাণ করায় ৬০ কোটি টাকা সরকারি অর্থের অপচয় হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সংস্থার প্রধান হওয়া সত্ত্বেও সোর্স মানি হিসাবে শুল্ক গোয়েন্দা ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) থেকে টাকা নিতেন নজিবুর রহমান। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন তৎকালীন দুই ডিজি। সোর্সের নাম সরকারি দলিলদস্তাবেজে উল্লেখ না করার বাধ্যবাধকতা থাকায় টাকা সরাতে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো।
অন্যদিকে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের টাকায় দেশবিদেশ ঘুরেছেন। সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক ভিয়েতনামে ১০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। এর পরিবর্তে আমেরিকায় বিজনেস টাইকুনদের মতো প্রটোকলে সপরিবারে নজিবুর রহমানকে ঘুরিয়ে আনা হয়।