মানি লন্ডারিংকে গুরুত্ব দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ
ইমন রহমান
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলেও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে তার আর্থিক দুর্নীতির বিষয়গুলো। আওয়ামী লীগ আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে নানা অনিয়মের মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি। বহুমুখী জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে আগে থেকেই বিতর্কিত ছিলেন তিনি। হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে তিন দিনের রিমান্ডে আছেন নজিবুর রহমান। রিমান্ডে তার আর্থিক দুর্নীতির বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম। টিমের নেতৃত্বে ছিলেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। এছাড়া যুবদল নেতা শামীম হত্যাকাণ্ডে তার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পল্টন মডেল থানা পুলিশ। ডিবি মতিঝিল বিভাগও নজিবুর রহমানের নানা অপকর্মের ছায়াতদন্ত করছে। এদিকে ডিবির হাজতখানায় সাধারণ কয়েদিদের মতোই রাখা হয়েছে তাকে। এক রুমে চারজনের সঙ্গে আছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় যুবদল নেতা শামীম মোল্লা নিহতের মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন নজিবুর রহমান। মামলাটি তদন্ত করছে ডিএমপির পল্টন থানা পুলিশ। রোববার রাতে গুলশানের বাসা থেকে নজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সোমবার তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ সময় তাকে জুতা ও পচা ডিম নিক্ষেপ করে সংক্ষুব্ধরা। জানতে চাইলে ডিএমপির ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, নজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিআইডির একটি টিমও মঙ্গলবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
নজিবুর রহমানকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, ‘না, আমার কাছে সব আসামিই সমান। তিনি অন্যান্য সাধারণ আসামির মতোই আছেন।’
ডিবিতে যেভাবে আছেন নজিবুর : রিমান্ডে ডিবিতে কেমন আছেন, কীভাবে তার সময় কাটছে এ বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ডিবির হাজতখানায় ফ্লোরে ঘুমাচ্ছেন। শুয়ে-বসে তার দিন কাটছে। তাকে দেওয়া হচ্ছে ডিবির ক্যান্টিনের খাবার।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ডিবিতে আসামি রাখার রুম (হাজতখানা) আছে মোট তিনটি। প্রতিটি রুমে তিন থেকে চারজন করে আসামি আছেন। নজিবুরের সঙ্গে আরও তিনজন আছেন। রুমে কোনো চেয়ার-টেবিল বা ঘুমানোর খাট কোনো কিছুই নেই। ফ্লোরিং করে থাকছেন তিনি। তাকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। অন্যান্য সাধারণ আসামিরা যে সুবিধা পাচ্ছেন একই সুবিধা পাচ্ছেন নজিবুর।
তার খাবারের বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে নাস্তার জন্য রুটি ও গুড় দেওয়া হয় নজিবুর রহমানকে। কিন্তু তিনি গুড় না খাওয়ায় পড়ে মিক্সড ভেজিটেবল এনে দেওয়া হয়। এরপর নাস্তা করেন। দুপুরে ডাল ও রুই মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। এসব খাবার ডিবির ভেতরের ক্যান্টিন থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে। বাইরে থেকে কোনো খাবার তার জন্য আনা হচ্ছে না।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, নজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধানে নেমেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ। তার বিষয়ে অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিমই মঙ্গলবার নজিবুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমরা সার্বিক বিষয়ে নজিবুর রহমানকে রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।’
নজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলার বিষয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশ প্রতিরোধে মাঠে নামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হামলায় নিয়ত হন যুবদল নেতা শামীম। এ ঘটনায় ১৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপির পল্টন মডেল থানায় ৭০৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সদস্য ও জাতীয়তাবাদী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্বাস আলী। ওই মামলা তদন্তে নেমে নজিবুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পায় তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তন্ময় কুমার বিশ্বাস।
এসআই তন্ময় কুমার বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, শামীম হত্যা মামলার এজাহারে নজিবুর রহমানের নাম না থাকলেও অন্য আসামিদের গ্রেফতারের পর তদন্তে তার নাম উঠে আসে। এর প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত রিমান্ড শেষে আদালতকে অবগত করা হবে।
নজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর রিমান্ড আবেদনে এসআই তন্ময় কুমার বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন, বিস্তারিত তদন্তে ও এ মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তদন্তে সন্দিগ্ধ গ্রেফতার আসামি মো. নজিবুর রহমান এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগ যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে বিএনপির সমাবেশকে পণ্ড করার জন্য আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।
পল্টন থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুর সোয়া ১২টা থেকে ২৯ অক্টোবর গভীর রাত পর্যন্ত পল্টনসহ ঢাকা শহরের আশপাশ এলাকায় ধারালো অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, পিস্তল, লাঠি, লোহার রড, চাপাতি দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা পুলিশের সহায়তায় মারধর করে বিভিন্ন নেতাকর্মীদের টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অবৈধভাবে আটক করে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। নিহত যুবদল নেতা শামীম মিয়াকে লোকজন ধরাধরি করে প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। ২৯ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে যুবদল নেতা শামীম মোল্লার লাশ পল্টন থানার একজন এএসআই কয়েকজন পুলিশসহ কাফনের কাপড় পরিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্সে পুলিশ পাহারায় শামীমের বাড়িতে পৌঁছে দেয়।