Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাবেক মুখ্যসচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

নজিবুরের বহুমুখী জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নজিবুরের বহুমুখী জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের সুবিধা নেন নজিবুর রহমান। এর মধ্যে অন্যতম শেয়ার কেলেঙ্কারি। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণ করেন। কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন (সিএমএসএফ) চেয়ারম্যান করা হয়। এছাড়া এনবিআরের জনবল নিয়োগে জালিয়াতি এবং প্রতিবন্ধী দেখিয়ে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। এসব সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একটাই পরিচয় ব্যবহার করেছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। শুধু এই পরিচয়ই আইনকানুন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। এদিকে নজিবুর রহমানের শেয়ার কেলেঙ্কারির বিষয়টি তদন্ত করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে রোববার রাতে গুলশানের বাসা থেকে নজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সোমবার তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ সময় তাকে জুতা ও পচা ডিম নিক্ষেপ করে সংক্ষুব্ধরা।

দেশের শেয়ারবাজারসহ আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন থেকে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়েছেন বহু বিতর্কিত ব্যবসায়ী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ শরাফাত, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ এবং এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। বর্তমানে এদের সবাই হয় জেলে না হয় পলাতক। ২০১৫ সালে এনবিআরের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসাবে নিয়োগ পান নজিবুর। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব করা হয়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণ করে শেয়ারবাজার থেকে নানা ধরনের সুবিধা নেন। এরপর তাকে সিএমএসএফের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।

শেয়ারবাজারে অত্যন্ত বিতর্কিত ও জালিয়াতপূর্ণ কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস (লা মেরিডিয়ান হোটেল)। এই কোম্পানি থেকে দুই ছেলের নামে ১০ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন নজিবুর রহমান। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এই পরিমাণ শেয়ার সাড়ে ৩ কোটি টাকায় কিনতে হয়েছে। এর বিনিময়ে জালিয়াতপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে সহায়তা করেন তিনি। আরও কয়েকটি কোম্পানি থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন নজিবুর। শেয়ারবাজারের ব্যাপারে নজিবুরের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নেই। এরপরও মুখ্য সচিব থেকে অবসরে যাওয়ার পর তাকে সিএমএসএফের চেয়ারম্যান বানান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য বিদায়ি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তবে সিএমএসএফের এখনো বৈধতা নেই।

বেস্ট হোল্ডিংস শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়। কিন্তু নজিবুর রহমান দুই ছেলের নামে বেস্ট হোল্ডিংয়ের ১০ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন। এর মধ্যে ফারাবী এনএ রহমান ৫ লাখ এবং ফুয়াদ এনএ রহমানের নামে ৫ লাখ শেয়ার নেন। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই শেয়ার নেন তিনি। কোম্পানিটির মূল্য নির্ধারণে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে এই শেয়ারের কাট অব প্রাইস (প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য) নির্ধারণ করা হয় ৩৫ টাকা। এর মানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১০ লাখ শেয়ার কিনতে সাড়ে ৩ কোটি টাকা লেগেছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। একটি নিষিদ্ধ অডিট ফার্মকে দিয়ে অডিট করানোর পর সম্পদ অনেকগুণ বাড়িয়ে দেখায়। এরপর শেয়ারবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ঘুস হিসাবে দেওয়া হয় প্লেসমেন্ট শেয়ার। নজিবুর রহমানের দুই ছেলের নামে ১০ লাখ শেয়ার দেয় বেস্ট হোল্ডিংস। এছাড়া তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ে তাহসিন রিশতা বিনতে বেনজীর ১ লাখ এবং ফারহিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে এক লাখ শেয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এই সবকিছুর আয়োজন করেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী নাফিজ শরাফাত। এসব বিষয় নিয়ে যুগান্তরে তিনটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এদিকে বিএসইসির সদ্য বিদায়ি চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন নজিবুর রহমান। নজিবুর রহমান শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এ কারণে তৈরি হয় এই ঘনিষ্ঠতা। পরে নজিবুরকে সিএমএসএফের চেয়ারম্যান করেন শিবলী রুবাইয়াত। এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশের টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা। কিন্তু নজিবুর রহমানের শেয়ারবাজার সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই পরিচয়ে তাকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানটি বাজারে অত্যন্ত বিতর্কিত। প্রতিষ্ঠানটির আইনি ভিত্তি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলছে। ফলে ব্যাংকগুলোর অবণ্টিত লভ্যাংশ এখনো এই প্রতিষ্ঠানকে জমা করার অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

অন্যদিকে সুস্থ ছেলে ফারাবি এন এ রহমানকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন নজিবুর রহমান। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে বিজনেস ফ্যাকাল্টির ফাইন্যান্স বিভাগে তাকে ভর্তি করানো হয়। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন ফ্যাকাল্টির তৎকালীন ডিন শিবলী রুবাইয়াত। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী নজিবুর রহমানের ছেলে ফারাবি এনএ রহমান প্রতিবন্ধী হিসাবে তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কিন্তু ফারাবির সহপাঠী, শিক্ষক ও পরিচিতজনরা জানিয়েছেন, তিনি কখনো শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছিলেন না। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার আবেদনেও তিনি প্রতিবন্ধী কোটার পাশে টিক চিহ্ন দেননি। কিন্তু মেধার পরীক্ষায় চান্স না পাওয়ায় তাকে প্রতিবন্ধীর কোটায় ভর্তি করা হয়।

এদিকে নজিবুর রহমানের আলোচিত কেলেঙ্কারির মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৬ সালে রাজস্ব প্রশাসনে নিয়োগ জালিয়াতি। উচ্চমান সহকারী পদে লিখিত পরীক্ষায় ২৭ নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে ৭০ দিয়ে চাকরি দিতে চাপ দেন তিনি। এনবিআর চেয়ারম্যানের পদে থাকায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে পরিবর্তন আনেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে উচ্চমান সহকারীর ৩৬টি শূন্যপদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩৬টি পদের বিপরীতে ২৩ হাজার ৪শ প্রার্থী আবেদন করলেও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১০ হাজার ৮০০ জন। তবে লিখিত পরীক্ষার জন্য উত্তীর্ণ হন ১৮০ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান নিজেই ১১ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তদবির করেন। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় তাদের বেশির ভাগই অকৃতকার্য হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কমিশনারকে নিজ দপ্তরে নিয়ে কমিশনারকে ভর্ৎসনা করেন। পরে প্রার্থীদের নাম ও রোল নম্বর উল্লেখ করে খাতার নম্বর পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। এতবড় জালিয়াতি সম্ভব না হলে পুরো নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের নির্দেশ দেন নজিবুর রহমান। পরে ওই বছরের ২২ আগস্ট নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, ‘উচ্চমান সহকারীর এই পদে নিয়োগে জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। সূত্র আরও জানিয়েছে, চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকাস্থ ভ্যাট এলটিইউর উচ্চমান সহকারীসহ বিভিন্ন শূন্যপদে নতুন নিয়োগেও নজিবুর রহমান চাপ দিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেন। তবে নজিবুর রহমানের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। অন্যদিকে নজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর সোমবার তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। আদালতে রিমান্ড শুনানিতে নজিবুর রহমানের বিষয়ে আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী আদালতে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা অবৈধ টাকা হাত করত। টাকা উদ্ধারের কথা বলে ডামি মামলা করত। পরে তদন্ত করে বলত অভিযোগ নেই। দুদক যেন মামলা না করে সেই সার্টিফিকেটও দিত। দেশের সম্পদ লুট করে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য যা যা করার করেছেন। এদিকে এজলাসে নেওয়ার সময় নজিবুর রহমানকে বিএনপির নেতাকর্মীরা পচা ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম