চট্টগ্রামের রাউজান
ফজলে করিমের কথা ছাড়া নড়ত না ‘গাছের পাতাও’
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
চট্টগ্রামে ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৬ রাউজান সংসদীয় আসনটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। এ আসনে কখনো ভোটে, কখনো বিনা ভোটে নির্বাচিত পাঁচবারের সংসদ-সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ছিলেন সর্বেসর্বা। তার কথা ছাড়া যেন এখানে ‘গাছের পাতাও’ নড়ত না। বিএনপি-জামায়াত-মুনিরিয়াসহ ভিন্নমতের লোকজন তো বটেই; নিজ দলের লোকজনও তার অনুগত না থাকলে কিংবা কোনো কারণে বিরোধিতা করেছেন মনে হলে তাকে এলাকাছাড়া করেছেন ফজলে করিম। নিজ দলের লোক নির্বাচন করে মেয়র নির্বাচিত হলেও একদিনের জন্যও মেয়রের চেয়ারে বসতে পারেননি। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা রয়েছেন, যাদের বাড়ি রাউজানে। কোনো একদিন যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, সেজন্য তাদের এলাকায় যেতে দেননি ফজলে করিম। ভিন্নমতের অনেক চিকিৎসকের চেম্বার বন্ধ করে দিয়ে এলাকাছাড়া করার নজিরও রয়েছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অন্তত ২০০ শিক্ষককে বাধ্য করেছেন পদত্যাগে। আবার তার মন জয় করে অনেকে লুটে নিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা। রাউজান নোয়াপাড়া কলেজের এক শিক্ষিকার জন্য সরকারি টাকায় কলেজে ‘বাসভবন’ গড়েছেন। গ্যাসের আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকায় ওই বাসভবনে নিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংযোগ। সেই শিক্ষিকা নিজের স্বামীকেও দিয়েছেন ডিভোর্স। সালসাবিল চৌধুরী নামে ওই শিক্ষিকা ফজলে করিমের ‘বান্ধবী’ হিসাবেই এলাকায় পরিচিত।
এছাড়াও সরকারি জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ, রাস্তা না থাকা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণ, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বিপুল অর্থ ব্যয়ে রেস্টহাউজ নির্মাণসহ নানাভাবে অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভিন্নমত দমনে খুন, অপহরণ, নির্যাতনের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবেও তাকে চিহ্নিত করেছেন ভুক্তভোগীরা। ৭০-৮০ জনের একটি বাহিনী ছিল তার। টানা ১৭ বছর দমবন্ধ করা দুঃশাসন চালিয়েছেন তিনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান রাউজানের এই দানব। ওইদিন থেকেই যেন রাউজানের সাধারণ মানুষ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেন। আর ভুক্তভোগী ও নির্যাতিতরা আসতে থাকেন প্রকাশ্যে। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগে এক ডজনের মতো মামলা হয়েছে। ভারতে পালানোর সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে বিজিবির হাতে ১২ সেপ্টেম্বর আটকের পর বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
তবে তার অনুসারীরা বলছেন, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফজলে করিম বিরোধী দলের সংসদ-সদস্য থাকলেও রাউজান যেতে পারেননি একদিনের জন্যও। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের লোকজন তাকে এলাকায় যেতে দেননি। আর সেই প্রতিশোধ নিতেই তিনি ভিন্নমতের লোকজনের ওপর ১৫ বছরেরও বেশি সময় স্টিমরোলার চালিয়েছেন।
ফজলে করিম সালাউদ্দিন কাদেরের চাচাতো ভাই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও বিপুল ভোটে হেরে যান ফজলে করিম। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হন তিনি। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সব নির্বাচনে পছন্দের লোকজনকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে দিতেন ফজলে করিম। এর আগে ২০১১ সালের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েও এলাকায় যেতে পারেননি উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল হাছান। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ফজলে করিমের অমতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক দেবাশীষ পালিত। তবে তিনি একদিনের জন্যও বসতে পারেননি মেয়রের চেয়ারে। কেবল এ দুজনই নন; যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের বাড়ি ছিল রাউজানে। তারাও ফজলে করিমের কথা ছাড়া রাউজানে পা রাখতে পারেননি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী গত ১৫ বছর এলাকায় যেতে পারেননি। ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ যুগান্তরকে বলেন, তিনি বিএনপি করতেন, এই অপরাধে তাকে ১০ বছর এলাকায় চেম্বার করতে দেওয়া হয়নি। ডা. ওমর ফারুক নামে আরেকজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞও ফজলে করিমের নির্যাতনের কাহিনি তুলে ধরেছেন। তাকেও এলাকাছাড়া করেছিলেন।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, যুগ্মসম্পাদক দেবাশীষ পালিত, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুসলিম উদ্দিন খান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, উপজেলা উত্তরের সভাপতি জিল্লুর রহমান, উপজেলা দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিনসহ দলীয় অনেক নেতাকর্মীও তার রোষানলে পড়ে এলাকাছাড়া হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো সংবাদিকও কলম ধরতে পারতেন না। দেবাশীষ পালিত জানান, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও বিরোধী দলের মতো পালিয়ে বেড়াতেন তিনি। কেউ তার ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট করলে তাকে ধরে নিয়ে মারধর করা হতো। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রবাস থেকে ফিরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে গ্রামে যান ওমানের বিএনপি নেতা মুহাম্মদ মুসা (৪৫)। কিন্তু ফজলে করিমের লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
ফজলে করিমের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক নুরু আলম নুরুকে ২০১৭ সালে চকবাজারের বাসা থেকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গত ৭ বছর এ ঘটনায় মামলা করতে পারেনি তার পরিবার। সরকার পতনের পর গত সেপ্টেম্বর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন নুরুর স্ত্রী সুমি আক্তার। এতে ফজলে করিমসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৩ সালে উপজেলার বাগোয়ানে মোজাম্মেল হক ও মুহাম্মদ সুমন, ২০১৫ সালে যুবদল নেতা আবুল হাশেম, ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আজিম, ২০২০ সালে যুবদল নেতা আবদুর রশিদ খুন হন রাউজানে। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনেও রাউজানের তৎকালীন সংসদ-সদস্যের ইন্ধন রয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দাবি করেছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও রাউজানে শেখ রাসেল রেস্টহাউজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। উত্তর পাহাড়তলী নোয়াপাড়া এলাকায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বেশকিছু সেতু নির্মাণ করেছেন, যেখানে কোনো সড়ক নেই। কেবল প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাটের জন্যই এসব করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। রাউজান পৌরসভার ফকির তাকিয়া এলাকায় ৫ একর জায়গার ওপর ফজলে করিম চৌধুরী ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন বাগানবাড়ি। এখানে অর্ধেকই হচ্ছে সরকারি খাসজমি। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও দখল করা হয়েছে। এমন অভিযোগে মামলাও হয়েছে। নোয়াপাড়া পথেরহাট বাজারে সরকারি খাস এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি দখল করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তরিকতপন্থি সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটির ৪৬টি শাখা কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের বিএম শাখার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সালসাবিল করিম চৌধুরীকে অধ্যক্ষের জন্য নির্মিত বাসভবন অনৈতিকভাবে বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এই কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী বিরুদ্ধে। অনেকের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও ওই শিক্ষিকা বাসা বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাসভবন নির্মাণে বিপুল অর্থের শ্রাদ্ধ করা হয়েছে। মাত্র ১০০ টাকা ভাড়ায় এ বাসা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ৮ হাজার টাকা গ্যাস বিল দিতে হয়। আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকলেও কর্ণফুলী গ্যাস থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংযোগ নিয়ে দেন ফজলে করিম।