Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অনেকের অবস্থা করুণ

দীর্ঘ চিকিৎসায় ভেঙে পড়েছেন তারা

স্কুলছাত্র আল আমিনের এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে * স্কুলছাত্র শাহীন, মাদ্রাসাছাত্র সাদ আবদুল্লাহ পা হারানোর শঙ্কায়

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দীর্ঘ চিকিৎসায় ভেঙে পড়েছেন তারা

দীর্ঘ চিকিৎসায় ভেঙে পড়েছেন তারা

শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) তৃতীয়তলার মডেল ‘বি-ওয়ার্ড’। রোববার দুপুরে ওয়ার্ডটিতে ঢুকেই আনুমানিক ১০ ফুট দূরত্ব থেকে মনে হচ্ছিল পশ্চিম কোনায় পি-৪২ নম্বর বিছানার বালিশে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করছেন একজন রোগী। তবে কাছে গিয়ে দেখা যায়, বাঁ পায়ে স্যান্ডেলের সঙ্গে রশি বেঁধে ডান হাত দিয়ে পায়ের মুভমেন্টের চেষ্টা করছেন তিনি। একই সঙ্গে বাঁ হাতে শয্যার রডের সঙ্গে বাঁধা গামছা ধরে শরীরের ভারসাম্য রাখার নিদারুণ চেষ্টা করছেন! তাতেও কাজ না হওয়ায় একজন তার পিঠের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুভমেন্টে সহায়তা করছেন।

জানতে চাইলে পাশে দাঁড়ানো কিশোর আবু সাইদ যুগান্তরকে জানান, মাদ্রাসাছাত্র সাদ আব্দুল্লাহ (১৯) তার বড় ভাই। মিরপুর ১-এ অবস্থিত আবু হুরায়রা কওমি মাদ্রাসা থেকে কুরআন শরিফ হেফজ শেষ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট দুপুরে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার পালানোর খবরে সবাই যখন আনন্দ করছিলেন, সেই সময় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাদ আব্দুল্লাহ বিজয় মিছিল দেখতে গিয়েছিলেন। মিরপুর-১ থেকে ২ নম্বর এলাকায় যাওয়ার পর হঠাৎ পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সাধারণ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন ভয়ে সবাই দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। সাদ ওভারব্রিজে ওঠে পড়ে। ওই সময় পুলিশের বুলেটে সাদের বাঁ হাঁটুর হাড় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুলিশ রক্তাক্ত সাদের কাছে কাউকে ভিড়তে দেয়নি। পরে পুলিশ একটু দূরে সরে গেলে কয়েকজন মিলে তাকে পাশের বেসরকারি ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা গুলিবিদ্ধ সাদের পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে আরেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে দুদিনে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। খরচ জোগাড় করতে না পেরে তাকে ৭ আগস্ট পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যন্ত্রণায় দগ্ধ সাদ আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমার বাবা উত্তরার নয়ানগর চেয়ারম্যান এলাকার একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। বেতন পান ১০ হাজার টাকা। বাবার আয়ে আমরা চার ভাই-বোন পড়াশোনা করছি। আহত হওয়ার পর চিকিৎসা খরচ জোগাতে না পেরে এখানে আসি। প্রথমে ১নং ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ ভর্তি রাখে। সেখান থেকে আরেক ওয়ার্ডে নেয়। সবশেষ এখানে ঠাঁই হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, আমার পায়ে পরানো লোহার খাঁচা ৯ মাস পর খোলা হবে। বর্তমানে হাঁটতে না পারায় বিছানায় বসেই পায়খানা-প্রস্রাব করতে হচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে, টানা ছয় সপ্তাহ চিকিৎসার পর ছাড় দেওয়া হবে। কবে আমি এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব, জানি না। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমি ও আমার পরিবার।

পঙ্গু হাসপাতালের চতুর্থ তলার একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন ছাত্র আন্দোলনে পা হারানো নবম শ্রেণির ছাত্র আল আমিন। বাড়ি পাবনার আমিনপুর থানায়। তার বাবা সিএনজিচালক বাবুল হোসেন স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বাড্ডা এলাকায়। আল-আমিন গ্রামের বাড়িতে দাদার সঙ্গে থাকতেন। ছাত্র আন্দোলন শুরুর দিকে ঢাকায় মা-বাবার কাছে বেড়াতে এসেছিলেন।

আল-আমিনের মা আছিয়া বেগম যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মেরুল বাড্ডা এলাকায় পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে যায় আমার ছেলে। কিছুদূর এগোতেই তাদের মিছিল পুলিশের সামনে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পালটা ধাওয়া। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে অনেকেই পা, বুক, হাত, পিঠসহ শরীর জখমপ্রাপ্ত হয়। আল আমিন গুলিবিদ্ধ হলে ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাড্ডা এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করে। পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু ছেলের পায়ে গুলি লাগার কারণে মাংসে পচন ধরে। এ কারণে চিকিৎসকরা আমার ছেলের বাম পা কেটে ফেলেন। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসা চলছে।

আল আমিন বলেন, প্রথমে পা কাটার পর খুব খারাপ লাগত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো আমার পা নেই। কিন্তু এখন আগের মতো খারাপ লাগে না। দেশের জন্য এক পা দিয়েছি। আরেক পা তো আছে। এটাই সান্ত্বনা। আল আমিন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। মা-বাবা আমার জন্য খুব কষ্ট করছে। হাসপাতালে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় কোনো উপায় দেখছি না। তার বাবা বাবুল হোসেন বলেন, ছেলে পা হারানোর প্রথমদিনই ১০ ব্যাগের বেশি রক্ত লেগেছে। কিন্তু আমি এক ব্যাগও জোগাড় করতে পারিনি। সবই ছাত্র ও বিভিন্ন মানুষ দিয়েছে। যারা আমার ছেলেটার এ অবস্থা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই। কেন গুলি করে পঙ্গু করে দিল তারা।

আল আমিনের মতো পা কাটা না পড়লেও পা হারানোর শঙ্কা নিয়ে হাসপাতালে মরণযন্ত্রণা ভোগ করছে নবম শ্রেণিপড়ুয়া ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মো. শাহীন। ৫ আগস্ট ঢাকার উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে। কথা বলে জানা যায়, শাহীনরা দুই ভাই। দুজনই দাদার বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বাবা আ. জব্বার প্যারালাইসিসের রোগী। বিছানায় শয্যাশায়ী। তার মা শিউলি বেগম উত্তরা এলাকায় মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার এবং তাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালান। আন্দোলনের মাঝখানে মা-বাবাকে দেখতে ঢাকায় আসে শাহীন। ৫ আগস্টে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরলেও কোনো হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন শাহীন।

তিনি বলেন, প্রথমে চিকিৎসা নিলে আজ আমি আরও ভালো থাকতাম। আমার পায়ের অবস্থা এত খারাপ হতো না। তবুও বেঁচে আছি। আমার সঙ্গে একজনের বুকে গুলি লাগে, আরেকজনের শরীরে বেশ কয়েকটা গুলি লাগে। এসব ঘটে আমার সামনেই। আমার পায়ে যখন গুলি লাগে, তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাই। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।

শাহীনের পাশেই বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন দাদি লাইলি বেগম। তিনি বলেন, ছোট থেকেই ওরা দুই ভাই আমার কাছে থাকে। আমিই অনেক কষ্টে লালনপালন করে বড় করেছি। কখনো ভাবিনি এ অবস্থায় নাতিকে দেখতে হবে। আমরা গরিব মানুষ। তার মায়ের যৎসামান্য আয়ে টানাটানি করে সংসার চলে। এখন পর্যন্ত তার চিকিৎসায় ৮০ হাজার টাকা চলে গেছে। তার মা চিকিৎসার টাকা জোগাড় করবে না কাজে যাবে

রোগীদের দীর্ঘ চিকিৎসার বিষয়ে একাধিক চিকিৎসক বলেন, যারা ভর্তি আছেন, তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। কিন্তু দীর্ঘ চিকিৎসায় অনেকে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। রোগীদের মনোবৈকল্য দূর করতে মনোরোগ বিশষজ্ঞদের কাউন্সেলিং জরুরি হয়ে পড়ছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম