রেলপথ নির্মাণে লুটপাট
দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নেই
দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নেই
বিগত ১৬ বছরে রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশেই এই ব্যয় সবচেয়ে বেশি। রেলের সংশ্লিষ্ট সবাই মিলেমিশে দুর্নীতি করার কারণেই মূলত অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে এই নির্মাণ কাজ-এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নিজেদের পকেট ভারি করতে অত্যন্ত সুকৌশলে প্রতিটি প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। যা ছিল চোখে পড়ার মতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮০০ কোটি টাকা প্রকল্প করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি; ৮০০ কোটি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সতর্কও করেছে। কিন্তু আমলে নেয়নি বিগত সরকারের নীতিনির্ধারকরা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি অপরাধীদের। ফলে আলোচ্য সময়ে তারা নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছে এসব অপকর্ম। তবে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতোমধ্যেই সাবেক পাঁচ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের লুটপাটের ঘটনা অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিবহণ অবকাঠামো নিয়ে যৌথভাবে একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। প্লাটফর্মটির নাম এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুক (এটিও)। এতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন রেলপথ (নন-আরবান হেভি রেল প্রজেক্ট) প্রকল্প বিশ্লেষণ করে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় বের করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ভারতে প্রতিকিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ১২-১৬ কোটি টাকা, পাকিস্তানে ১৫-১৮ কোটি টাকা, চীনে ১৫-১৭ কোটি টাকা এবং ভিয়েতনামে ৯-১১ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশে রেলপথ নির্মাণে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৭৯ কোটি টাকা, ঢাকা-পায়রাবন্দর ১৯৬ কোটি, পদ্মা সেতু রেললিংক ২৩০ কোটি, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লেন ১০১ কোটি এবং টঙ্গী-ভৈরববাজার রুটে ১১৮ কোটি টাকা।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলপথ নির্মাণে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও সরকারের উপর মহলের চাপ ছিল। একেকটি প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় গড়ে ২ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। দুটি অগ্রাধিকার প্রকল্পসহ অন্তত ৭টি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ বিবেচনায় এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প শুরুতে ব্যয় কিছুটা কম ধরা হলেও পরে প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিভাবে বাড়ানো হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে জানান, রেলে নতুন রুট নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে-এমনটা বিশ্বব্যাংক থেকেও বলা হয়েছে। কিন্তু, উন্নয়নের নামে রেলে যে লুটপাট-দুর্নীতি হয়েছে, তা চলমান রাখতে তৎকালীন মন্ত্রী-সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা তা আমলে নেয়নি। বরং প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে হেঁটেছে। সবাই মিলেমিশে দুর্নীতি করেছে। তাই রেলে উন্নয়নের সুফলও নেই। ভয়াবহ দুর্নীতি আর অপরিকল্পিত প্রকল্পে রেলে অনিয়মের কঙ্কাল ভেসে উঠেছে। দুর্র্নীতিবাজদের জবাবদিহিতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে একটি কমিটি গঠন করে আগামীতে যাতে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। কারণ, সব দুর্নীতি ও অনিয়মের ভাগীদার তারাও।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, রেলে প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক। দুদকও অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। দুদক আমাদের কাছে আরও তথ্য-উপাত্ত চাইলে আমরা তা দেব। প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ রক্ষা পাবে না। আমরা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। রেলে যাতে নতুন করে আর কোনো প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতি না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর রাখছি। রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তি ইচ্ছায় কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। যেসব প্রকল্প দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে আসবে-সেগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। রেল সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষের কল্যাণেই গ্রহণ করা হবে প্রকল্প। প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন ব্যয় ও সময় নির্ধারিত থাকবে। কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বিন্দুমাত্র সহ্য করা হবে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল রেলপথ নির্মাণে রীতিমতো ‘ইতিহাস’ গড়ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনা ও সরকারের একান্ত ইচ্ছার প্রতিফল ঘটেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ছোটবড় মিলিয়ে সর্বমোট ১০৮৮.১৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এসব প্রকল্পে ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গড়ে প্রতিকিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ করা হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নতুন রেলপথ নির্মাণে দুটি অগ্রাধিকার প্রকল্পসহ ৭টি প্রকল্পে গড়ে প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ৭০ থেকে ২৩০ কোটি টাকা।
নতুন নির্মিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৭টি প্রকল্পে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বিগত সরকারের অগ্রাধিকার ‘দোহাজারী-কক্সবাজার-রামু’ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ওই পথে গড়ে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় প্রায় ১৭৯ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত এ প্রকল্পের শুরুতে ২০১০ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১৮০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি পিইসি সভায় ওই প্রকল্পের রামু-ঘুমধুম অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই অংশ বাদ দেওয়া হলে ব্যয় কমবে ৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।
ঢাকা থেকে যশোর পযর্ন্ত ‘পদ্মা রেললিংক প্রকল্প’র কাজ চলমান রয়েছে। ১৭১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ ২৩০ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এ রুট করা হচ্ছে। আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পে গড়ে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ হয় ৯০ কোটি টাকা। টঙ্গী-ভৈরববাজার রেলপথ নির্মাণ খরচ ১১৮ কোটি টাকার বেশি। তাড়াকান্দি-যমুনা ব্রিজ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হয় প্রায় ২২শ কোটি টাকা। এ রুটে কিলোমিটার খরচ হয় প্রায় ৬৩ কোটি টাকা।
এছাড়া ঢাকা-টঙ্গী ৩য় এবং ৪র্থ লেন লাইন স্থাপন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার খরচ হচ্ছে ১০১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে একাধিকবার সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৩ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা। রাজবাড়ী টঙ্গীপাড়া রেলপথ নির্মাণ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ২৩৫০ কোটি টাকা। এ পথে কিলোমিটার খরচ হয় প্রায় ৩১ কোটি টাকা।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার বছর খানেক আগে- ঢাকা-পায়রা বন্দর-কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে-যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদকাল ধরা হয়েছে। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৯৬ কোটি টাকা। আখাউড়া সিলেট রেলপথে মিটারগেজকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এ পথে প্রতিকিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭২ কোটি টাকা।
অপরদিকে টঙ্গী-ভৈরব হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। এ রুটে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় হবে ১৮৪ কোটি টাকার বেশি। অথচ এ পথের টঙ্গী-ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রায় ৬৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ গত ৭ বছর আগে নির্মাণ করা হয়।
এদিকে বিগত সরকারের শেষের দিকে লুটপাটের একটি অংশ হিসাবে রেলে ‘অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ নামক একটি পরিকল্পনা যুগান্তরের হাতে এসেছে। সর্বশেষে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য প্রেরিত-পরিকল্পনায় ৩৬টি প্রকল্পের পরিকল্পনা উঠে আসে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রেলপথ নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য ছিল। রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকার আর কয়েক মাস সময় পেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী এ ৩৬টি প্রকল্পও গ্রহণ করে ফেলত। অথচ ২৯টি চলমান প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) চাহিদা সবচেয়ে লোভনীয়। আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরে শুধু একটি প্রকল্পে রেলের বাহির থেকে একজন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে ৯৫টি সমাপ্ত প্রকল্প ও চলমান ২৯টি প্রকল্পের পিডি-সবাই রেলের কর্মকর্তা। অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরের কোনো কর্মকর্তাকে বিশেষ করে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে কখনও পিডি দেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-একেকটি পিডির নিয়োগ পেতে মন্ত্রী-সচিব এবং সংশ্লিষ্টদের ২ থেকে ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এমন কোনো পিডি নেই যে পিডির দায়িত্ব পালনকালে প্রকল্পের মেয়াদ-ব্যয় এক থেকে ৩ বার পর্যন্ত বাড়ানো হয়নি। বর্তমান সরকার বিভিন্ন রেল প্রকল্পের পিডির আমলনামার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করেছে। প্রয়োজনে তা দুদককে দেওয়া হবে।