বিএসইসিতে ১২৭ জনের নিয়োগ জালিয়াতি
তদন্ত করে উচ্চ আদালতে দাখিলের নির্দেশ
যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) ১২৭ জন জনবল নিয়োগে জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত করে ৩ মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছেন উচ্চ আদালত। যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টকে ভিত্তি করে বিচারপতি একেএম আসাদুউজ্জামান এবং মুহাম্মদ মাহবুবুল ইসলামের বেঞ্চ ৫ সেপ্টেম্বর এই আদেশ দেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকছুদ ও সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে দেওয়া হয় এ আদেশ। এ হিসাবে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
বিএসইসির মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আদালতের আদেশের কপি তারা এখনও পাননি। এই কপি হাতে পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশনের পার্টনার ব্যারিস্টার মো. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে উচ্চ আদালত বন্ধ (ভ্যাকেশন চলছে)। আশা করছি আদেশটি এক সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের কাছে চলে যাবে।’
‘বিএসইসির নিয়োগ পদোন্নতি ও পদায়নে বেপরোয়া জালিয়াতি স্বেচ্ছাচারিতা’ শিরোনামে ৮ জুলাই অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে যুগান্তর। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে ১২৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর একটি বিশাল অংশ নিয়োগে বিদ্যমান আইন, বিধিমালা ও সরকারি আদেশের তোয়াক্কা করেনি বিএসইসি। করোনার সময়ে সরকারি নির্দেশে যখন দেশব্যাপী লকডাউন চলছিল, তখন তড়িঘড়ি করে এই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনাও আমলে নেয়নি কমিশন। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিএসইসির এই কাজকে সংবিধান পরিপন্থি উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. আরিফ চৌধুরী। রিট পিটিশন নাম্বার ১০৮৩২/২৪। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে বিপক্ষ করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ৫ সেপ্টেম্বর আদেশ দেন আদালত।
যুগান্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্নভাবে শেয়ারবাজার থেকে সুবিধাভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের দুজন অধ্যাপকের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় এই নিয়োগ। এক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রও কমিশনে আসেনি। পরবর্তী সময়ে এই দুজনকে শেয়ারবাজার সংক্রান্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।
বেআইনিভাবে শেয়ার লেনদেনের কারণে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরপর পদত্যাগ করেন তিনি। বর্তমানে শেয়ার লেনদেনের বিষয়টি তদন্তাধীন। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. মোহাম্মদ তারেককে।
তার নিয়োগেও জালিয়াতি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যুগান্তর। এরপর তিনিও পদত্যাগ করেন।
এই শিক্ষকদের সহায়তায় ওই সময়ে কমিশনে যাদের নিয়োগ হয়েছেন এরা হলেন- সহকারী পরিচালক (জেনারেল)-শরিফুল ইসলাম, রানা দাস, লামিয়া আক্তার, সাকিল আহমেদ, আতিকুল্লাহ খান, সৌরভ মল্লিক, মারজিয়া জাহান, জনি হোসাইন, মো. ফয়সাল ইসলাম, নুজহাত খাদিজা মিম, মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, মো. মতিউর রহমান, মো. কামাল হোসেন, মোহাম্মদ সাদেকুর রহমান ভূঁইয়া, তম্ময় কুমার ঘোষ, মাহমুদুর রহমান, মো. সাগর ইসলাম, মো. মারুফ হাসান, মো. মোসাব্বির আল আশিক, মো. আমিরুল ইসলাম, মো. মেহেদী হাসান রনি, মো. রায়হান কবির, অমিত কুমার সাহা, মো. আনোয়ারুল আজিম, মিথুন চন্দ্র নাথ, বিভাস ঘোষ, মো. আরিফুল ইসলাম, মোহাম্মদ মিনহাজ বিন সেলিম, মিস ফারহানা ওয়ালেজা, মো. তারিকুল ইসলাম, মো. আশরাফুল হাসান, মিস মাকসুদা মিলা, ফারজানা ইয়াসমিন, মো. হাসান, মো. মিজানুর রহমান, মো. নিজাম উদ্দিন, মো. মাহমুদুল হাসান, শাকিলা সুলতানা, আলী আহসান, মেহরান আলী, দিপঙ্কর মন্ডল, আসমা উল হুসনা, বিনয় দাস, আকরাম সিরাজ, মো. আরিফুল ইসলাম, মো. আবদুল আউয়াল, অমিত অধিকারী, মো. আবদুল বাতেন, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. মাহমুদুর রহমান, মো. আবু হেনা মোস্তফা, মো. সাজ্জাদ হোসেন, সারাহ তাসনুবা, ইনজামুল হক এবং মোহাম্মদ রুমান হোসাইন।
সহকারী পরিচালক (এমআইএস)- আসওয়াদ দেওয়ান, নিলয় কর্মকার ও মো. ইয়াসিন রহমান। সহকারী পরিচালক (লিগ্যাল)-মো. মাসুম বিল্লাহ, মো. তাওহিদুল ইসলাম সাদ্দাম, আল ফরহাদ বিন কাশেম ও নাভিদ হাসান খান। অ্যাকাউন্টস অফিসার-ফাবলিহা ফায়রুজ। জনসংযোগ কর্মকর্তা-সানাউল্লাহ হাসান ও মো. মোহাইমিনুল হক।
ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-আসমা-উল-হুছনা, মোহাম্মদ মুশফিকুর রহমান, ফারুক আহমেদ, নাঈম আহমেদ, কাওসার পাশা বৃষ্টি, সমির ঘোষ, মো. মাহাবুবুর রহমান, মো. রাকিবুল ইসলাম আকন, ফারজানা আক্তার, গোলাম সারওয়ার, মোশারফ হোসাইন, বিপ্লব কুমার, নাবিদ ইমতিয়াজ আলী, কাজী রাহবার রুমী শান্তা, মওদুদ আহমেদ মামদুদ, মো. মিরাজ হোসেন, মোহাম্মদ এমদাদ হোসেন মামুন, মো. গোলাম মোরশেদ, ফকরুল ইসলাম, মো. রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ বিল্লাল হোসাইন, সোহেলী আক্তার, অনিকা তাবাসসুম, মো. বেতাব হোসেন খালাসী এবং মো. কাওসার বিন গনি। লাইব্রেরিয়ান-মো. সেলিম রেজা বাপ্পি। সহকারী অ্যাকাউন্টস অফিসার-হুমায়রা খানম, হাসিবুল ইসলাম এবং মো. ইরফান ইমন। ক্যাশিয়ার-পার্থ প্রিতম সাহা। মেডিকেল সহকারী-প্রান্ত রায়।
রিসিপশনিস্ট-মাহফুজ আরেফিন। ড্রাইভার-মো. আবু সাকিব, মো. মনির হোসেন ও মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন। অফিস সহকারী-তানিয়া আক্তার, মো. খালেকুজ্জামান, খাদিজা খাতুন, মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন, মো. বেলাল হোসেন, মো. সোয়াইব, মো. কাওসার আলী, মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, মো. সরিফুল ইসলাম, প্রকাশ কান্তি রুদ্র, মানজিলা আক্তার, মো. শাকিল আহমেদ, পারভেজ রেজা শুভ, কাজী মাসুম, মো. আতাউর রহমান, মো. সুজন আলম, জাহিদুল ইসলাম, মো. আকরামুজ্জামান, মো. রিয়াসাদ রায়হান, নজরুল ইসলাম, মো. ইলিয়াস, আবির হোসাইন, মো. সায়িদ আনোয়ার, আবদুল মান্নান, রাকিবুল ইসলাম, আলফাতুন আরা এবং জগন্ময় দাস।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কমিশনে ১০ ক্যাটাগরির পদের বিপরীতে ১২৭ জন জনবল নিয়োগের জন্য ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএসইসি। আগ্রহীদের ২০২১ সালের ১ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই প্রজ্ঞাপনে ১৪ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
এ সময় অতি জরুরি প্রয়োজনীয় যেমন ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন এবং করোনার টিকা গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এজন্য সাধারণ মানুষের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশনা দিয়ে নামানো হয় রাস্তায়। এরপর ১৬ মে জারি করা হয় আরেকটি প্রজ্ঞাপন। পরে ২৩ মে পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদকাল বাড়ানো হয়। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যেই ২০২১ সালের ১৯ মে সহকারী পরিচালক পদে অনুষ্ঠিত হয় নিয়োগ পরীক্ষা। অর্থাৎ লকডাউনের ভেতরে সরকারের সব কার্যক্রম যখন বন্ধ ছিল, তখনই পরীক্ষা নেয় বিএসইসি। এক্ষেত্রে লকডাউনসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কাজটি করা হয়।
এর মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়। নিয়ম অনুসারে লিখিত পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের উত্তরপত্র কমিশনে আসার কথা। কিন্তু পরীক্ষার কোনো উত্তরপত্র কমিশনে পাঠানো হয়নি। শুধু উত্তীর্ণদের একটি তালিকা কমিশনে পাঠানো হয়। এই তালিকার ভিত্তিতে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া ১২৭ জনের এই সংখ্যা ওই সময়ে বিএসইসিতে কর্মরত মোট জনবলের ৭৮ শতাংশের সমান। অর্থাৎ বিএসইসির ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক এই জনবল নিয়োগের পুরোটাই রহস্যে ঘেরা।