তিন লাখ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ
নিশানায় রেলের চার দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী
রেলপথ মন্ত্রণালয়
রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৫ বছরেও কালো বিড়ালমুক্ত হয়নি। এ সময়ে মন্ত্রণালয়টি পাঁচ মন্ত্রীর হাতবদল হয়েছে। প্রতিবারই নেওয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে ব্যয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ১ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে বাংলাদেশে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার ব্যয় দেখানো হয়েছে। গত সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে রেলে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়ন হয়েছে ৯৫টি। ব্যয় হয়েছে সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি। বরাদ্দ থেকে লুটপাট হয়েছে। চলমান ২৯ প্রকল্প। রেলের সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য হয়েছে বেশুমার। প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি হয়েছে শত শত কোটি টকা। ভাগ গেছে শীর্যপর্যায় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার পকেটে। তারা দুর্নীতির টাকায় আরও ফুলেফেঁপে উঠেছেন।
গত ১৫ বছরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর আসনে একের পর এক বসেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, মো. মুজিবুল হক, মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও মো. জিল্লুল হাকিম। তাদের দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। ৫ মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করা রেলের সাবেক সচিব, ডিজি, প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির তথ্যও গোপন থাকছে না। পাঁচ মন্ত্রীর একজন নূরুল ইসলাম সুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সোমবার। বাকি তিনজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ চারজনই এখন নিশানায় আছেন। বাকি একজন মারা গেছেন। তাদের খুঁজছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন কিন্তু কাজ হয়নি, তারাই খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের। দুর্নীতি দমন কমিশনও তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। রেলের সর্বশেষ মন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে দুদকে। মামলা আছে ওবায়দুল কাদের ও মুজিবুল হকের নামেও।
জানা যায়, রেলের চলমান ২৯ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। দুটি মেগাসহ বড় প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের মেয়াদকাল এবং ব্যয় বৃদ্ধিও হয়েছে শীর্ষপর্যায়ের অনুমোদনের ভিত্তিতেই। রেলের ৫ মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টরা এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন। পাশাপাশি পকেট ভরার জন্য প্রকল্পগুলো থেকে তোলা আদায়ের চক্র গড়ে তোলেন। সচিব, ডিজি, প্রকল্প পরিচালকসহ বড় বড় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িয়েছে। যারা বিভিন্ন ধাপে কমিশন আদায় থেকে শুরু করে অর্থ ভাগবাঁটোয়ারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।
নূরুল ইসলাম সুজন : সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ অনিয়ম-দুর্নীতির একাধিক মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রিত্ব হারান। ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী’ স্লোগানে নেওয়া ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পে (৫৩টি রেলওয়ে স্টেশন সংস্কার) বড় অঙ্কের কমিশন নেন সুজন। আখাউড়া-লাকসাম, দোহাজারী-কক্সবাজার, পদ্মাসেতু রেললিংক প্রকল্পসহ তার সময়ে নেওয়া সব প্রকল্প এবং চলমান প্রকল্পগুলো নিজের কবজায় নেন। শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনায় অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, টার্গেট অনুযায়ী প্রকল্পের ঠিকাদার-প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে সচিবদের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে থেকে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠানো হতো মন্ত্রণালয়ে। পরে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। বিশেষ করে তার দ্বিতীয় স্ত্রী, শ্যালকসহ অন্যদের নিয়ে কমিশন চক্র গড়ে তোলেন। তার মেয়াদে রেল থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। দুর্নীতির উৎসই ছিল প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এছাড়া ‘সহজ ডটকম’ নামের টিকিট বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার একধরনের সখ্য গড়ে উঠেছিল। দুর্নীতির সঙ্গে সহজ সম্পৃক্ত এবং সহজের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হলেও সহজের হয়ে কাজ করেন খোদ মন্ত্রী। রেল সহজকে বাতিল করতে চাইলেও ‘বিশেষ চাহিদায়’ বড় অঙ্কের সুবিধার বিনিময়ে সুজন সহজকে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেন।
রেলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের (আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত) একের পর এক পদোন্নতি দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে কোটি কোটি টাকা পকেটে তোলেন। রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। প্রকল্পটির শুরুতে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও পরবর্তী সময়ে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ দেখানা হয়। মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করে এ অবস্থায় আনা হয়। অভিযোগ, এখান থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা লোটপাট করা হয়। আবাসিক-সংস্কার কাজে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। অডিট প্রতিবেদনে উঠে আসে, চরম অনিয়ম-দুর্নীতির এ চিত্র। এটি রেলের ছোট কাজগুলোর একটি।
১০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয় দুর্নীতিতে সরাসরি সায় দিয়েছেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী সুজন। চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে ক্রয় করা হয়নি। প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইঞ্জিনগুলো কেনার সঙ্গে রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি রেলওয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই উঠে আসে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তার হয়ে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী। অভিযোগ আছে, দুই কর্মকর্তাকে বাঁচিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার কমিশন নেন সংশ্লিষ্টরা।
মুজিবুল হক : ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য মো. মুজিবুল হক। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই তিনি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ। দরিদ্র পরিবারের কৃষকের সন্তান। চিরকুমার, কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।’ এরপর তিনি প্রায় ৭ বছর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। রেলে সমাপ্ত প্রকল্পের ৯৫টি এবং চলমান ২৯টির অধিকাংশই তার সময় নেওয়া হয়। তার হাত ধরেই ১৮শ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প ১৮ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার, পদ্মাসেতু রেলসংযোগ দুটি মেগা প্রকল্প ছাড়াও রেলে অন্তত ১৩টি প্রকল্প গ্রহণ হয় তার মেয়াদেই। এ ১৩ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) যথাযথ না করেই গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।
২০১৬ সালে পদ্মাসেতু রেললিংক নামের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। পরে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা করা হয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটার লাইন তৈরিতে খরচ হয়েছে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বিশ্বের চীনে অত্যাধুনিক রেলপথ (জিয়ানইয়া-লিনচেং রেলপথ) নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। বিশ্বের কোথাও ২ কোটি ডলার বেশি খরচ হয়নি প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে। অথচ বাংলাদেশে এ প্রকল্পে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার খরচ দেখানো হয়েছে। এক প্রকল্প থেকেই প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক লোটপাটের অগ্রভাগে ছিলেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
দরিদ্র পরিবারের কৃষকের সন্তান মুজিবুল হক দুর্নীতি করে পাহারসম সম্পদ বানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও দুদকে মামলা রয়েছে। নির্বাচনে দায়ের করা হলফনামায় ২০১৮ সালে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ২ কোটি ৮৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭১১ টাকা। স্ত্রী হনুফার ছিল ২ কোটি ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৩ টাকা। মন্ত্রিত্ব হারানোর পর হলফনামায় ২০২৩ সালে তার সম্পদ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৯ টাকা। স্ত্রী হনুফার নামে দেখানো হয় ৪ কোটি ৬৬ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৯ টাকা। এছাড়া নামে-বেনামে মুজিবুল হকের হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। সম্প্রতি তার বিছানায় ছড়িয়ে থাকা টাকার বান্ডিলের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার পরিবারের এক সদস্য জানান, নিয়োগ বাণিজ্যসহ প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা তিনি একা খাননি। এর ভাগ অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। যে কারণে নির্বিঘ্নে মুজিবুল হকদের মতো মন্ত্রীরা দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন।
সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মুজিবুল হক ও তার পরিবারের সদস্যরা। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি শত শত কোটি টাকা বানিয়েছেন। সম্পদ গড়েছেন তারও বেশি। শ্বশুরবাড়ি ও স্ত্রীর স্বজনদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। রাজধানীর ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে (রোড-এ) ৪ হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট আছে। বর্তমানে এর বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৪ তলা বাড়ি, রাজধানীর ৬০ ফিট আগারগাঁওয়েও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে। এছাড়া রাজধানীর বাসাবো, খিলগাঁও, কমলাপুর ও মিরপুরে তার জমি-বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। কুমিল্লার ঝাউতলা, কালীগঞ্জ, নিমসার, চান্দিনার মিরাখলায় বহুতল ভবনসহ জমি-ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা শহরসহ নিজ উপজেলায় জমি কিনেছেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, স্বজনদের নামে সম্পদ-জবাবদিহিতার আওতায় আনলে মুজিবুল হকের কালো বিড়াল বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মুজিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পলাতক থাকায় তার বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
জিল্লুল হাকিম : ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারিতে রেলপথমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই চলমান প্রকল্প ঘিরে ঠিকাদার, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কমিশন আদায়ের চক্র গড়ে তোলেন জিল্লুল হাকিম। তাছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে রেলওয়ের সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে কমিশন বাণিজ্য, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ তদন্ত করছে তদন্ত সংস্থাটি। ঢাকার উত্তরা, বনানী ও রাজবাড়ী শহরে বিলাসবহুল বাড়ি এবং রাজবাড়ীর তিন উপজেলায় ৫০০ বিঘার বেশি জমির মালিকানা রয়েছে তার। রাজধানীর বনানী সুপার মার্কেটের পেছনে অর্চার্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট রয়েছে তার।
ওবায়দুল কাদের : ২০১১ সালেই রেলপথ মন্ত্রণালয় কালো বিড়ালের দখলে চলে যায়। এ সময় নিয়োগ বাণিজ্যে শতকোটি টাকা লোপাটের পর এ মন্ত্রণালয় হয়ে উঠে সময়ের আলোচিত দুর্নীতির ক্ষেত্র। টাকা দিয়েও চাকরি পাননি অনেকে। তাদের অনেকেই মামলা করেছিলেন। এমন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বসেন ওবায়দুল কাদের। মাত্র ৫ মাস দায়িত্ব থাকা অবস্থায় রেলের বহু মূল্যবান জমি দলীয় এবং প্রভাবশালীদের হাতে চলে যায়। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া পুরোনো রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রেলের প্রায় ৪ একর জমি উদ্ধারের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে রেলের জমি দখল, বিভিন্ন স্থাপনা, রেলওয়ে মার্কেট তৈরিতে অদৃশ্য নির্দেশনা ছিল এই মন্ত্রীর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, ওই সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আনাগোনা ছিল রেলভবন ঘিরে। রেল খাতে দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ দলীয় নেতাদের অবস্থান ছিল কাদেরের কক্ষ ঘিরে। ওবায়দুল কাদের অফিস কক্ষের পাশেই লাগোয়া একটি বিশ্রামের কক্ষ ছিল। দলের নেতাকর্মী ও ঠিকাদারদের নিয়ে ‘আয়েশ ঘরে’ বিশ্রামের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। ওবায়দুল কাদের ২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন কারেন। এ সময় ছাত্রলীগ ও দলীয় ক্যাডাররা রেলওয়ে কোয়ার্টার, জমি একের পর এক দখলে নেয়। বিভিন্ন কোয়ার্টারে গড়ে তোলা হয় অবৈধ স্থাপনা-দোকানপাট ও গ্যারেজ। অভিযোগ আছে, ওবায়দুল কাদের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ও রেল নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত : মন্ত্রী হওয়ার পর ৪০ হাজার লোকবল নিয়োগের বিষয়টি নজরে পড়ে সুরঞ্জিতসহ লুটেরাদের। শুরুতেই ৭০০ লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। দলীয় লোকদের চাকরি নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয় একটি শক্তিশালী চক্র। যে চক্র নিয়োগপ্রতি ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা আদায়ের বিষয় ফয়সালা হয়। শুরু হয় নিয়োগ প্রক্রিয়া, নির্দিষ্ট টাকা সংগ্রহ। অনুসন্ধানে উঠে আসে, নিয়োগ ঘিরে ধাপে ধাপে শতকোটি টাকা সংগহ করে ‘সুরঞ্জিত চক্র’। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকেই চুক্তি অনুযায়ী নিয়োগের টাকা সংগ্রহ শুরু হয়। ওই টাকার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আগ্রহী প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে উঠানো হয়। ক্যাশিয়ার দুই অঞ্চলের জিএম। টাকা রাখা হয় ওই সময়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা, এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারসহ চক্রের সদস্যদের কাছে। ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে প্রায় কোটি টাকা নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় যাওয়ার পথে বিজিবির সদর দপ্তর পিলখানার মূল ফটকে আটক হয় জিএম, এপিএসসহ রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর এক কমান্ডেন্ট। ওই সময় আটক ব্যক্তিদের ভাষ্য, কোটি কোটি টাকার বস্তা নিয়ে বহুবার সুরঞ্জিত সেনের বাসায় রেখেছেন তারা। নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনায় ওই বছরের ১৭ এপ্রিল পদত্যাগের ঘোষণা দেন সুরঞ্জিত।
সচিবের বক্তব্য : রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, রেলের ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প নিয়ে নানান অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে। অনেক প্রকল্প নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দেশনায় গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রাথমিক সমীক্ষাও করা হয়নি। আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রী, সচিব কিংবা যে কেউ জড়িত থাকুক-সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির মাধ্যমে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লোটপাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ রক্ষা পাবে না।
রেলওয়ে উপদেষ্টার বক্তব্য : রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, রেলে ভয়ানক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তসহ অভিযোগ রয়েছে। আমরা এসব খতিয়ে দেখছি। রেলে উন্নয়নের নামে যে অনিয়ম-দূর্নীতি হয়েছে তা দুদক নিশ্চয়ই দেখছে। যতটুকু জানি দুদকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আমাদের কাছেও দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত আসছে। আমরা এসব দুদককে দিয়ে সহায়তা করব। রেলে যাতে এমন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং গুরুত্বহীন প্রকল্প গ্রহণ না হয়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। প্রকল্প ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কেউ বাঁচতে পারবে না। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছি।