Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

পদত্যাগ করলেন সিইসি ও চার কমিশনার

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুপারিশ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুপারিশ

দায়িত্ব নেওয়ার আড়াই বছরের মাথায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পদ ছাড়লেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার কমিশনার।

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সাংবাদিকদের সামনেই পদত্যাগপত্রে সই করেন সিইসি। চার কমিশনার নিজেদের মতো নিজ কার্যালয়ে পৃথক পদত্যাগপত্রে সই করেন। বেলা ১টার মধ্যে প্রথমে সিইসি এবং পরে তিন কমিশনার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তাবলয়ে নির্বাচন ভবন ছেড়ে চলে যান। তখন নির্বাচন ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ একদল ব্যক্তি তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে ধাওয়া করে এবং জুতা ছুড়ে মারে।

বৃহস্পতিবারই পদত্যাগপত্র বঙ্গভবনে পৌঁছে দেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব শফিউল আজিম। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ‘ডামি ভোট’ আয়োজনের অভিযোগ রয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের বিরুদ্ধে। ওই অভিযোগে বিভিন্ন মহলে তাদের পদত্যাগের দাবি ওঠে।

বিদায়ের আগে বেলা ১২টায় নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সৌজন্য বিনিময়’ করেন বিদায়ি সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। ওই সময়ে তার পাশে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান ও মো. আলমগীর। বাকি দুই নির্বাচন কমিশনার রাশেদা খানম ও মো. আনিছুর রহমান ওই সময়ে ইসি সচিবালয়ে থাকলেও সাংবাদিকদের সামনে হাজির হননি।

বিদায়ি ব্রিফিংয়ে নিজেদের পদত্যাগের কথা জানান। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কিত আখ্যা দেন সিইসি নিজেই। তিনি বলেন, আমিসহ কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থ করেছি। ওই বক্তব্যের পরই পদত্যাগপত্রে সই করেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ায় নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি-এমন উদাহরণ নেই।

সরকার বারবার বলছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এ কথার মধ্যেই নিহিত। তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে, দলের মধ্যে নয়।’ একই সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের প্রস্তাব দেন তিনি। নির্বাচনব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারেরও পরামর্শ দেন।

নির্বাচন কমিশনাররা পদত্যাগ করবেন-এ খবর আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বৃহস্পতিবার কমিশনের ভেতর ও বাইরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্য। পরিচয় ছাড়া ইসি সচিবালয়ে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সকালেই নির্বাচন ভবনে প্রবেশ করেন সিইসি ও চার কমিশনার। তারা কয়েকটি ফাইলে সই করেন।

বেলা ১১টায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন সিইসি ও চার কমিশনার। সেখানে শুধু সিইসি একাই বক্তব্য দেন। নির্বাচনি কাজে সহযোগিতা করায় তাদের ধন্যবাদ জানান। পরে বেলা ১২টায় সাংবাদিকদের বিদায়ি ব্রিফ করেন সিইসি। ব্রিফিংয়ের পর সিইসি তার এক আত্মীয়ের গাড়িতে চড়ে কমিশন সচিবালয় ত্যাগ করেন। চার কমিশনার ইসির গাড়িতে বের হন।

বৃহস্পতিবার বেলা ১টার মধ্যে বিদায়ি সিইসি ও তিনজন নির্বাচন কমিশনার ইসি সচিবালয় ত্যাগ করেন। আরেক বিদায়ি নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান ইসিতে থেকে যান। তিনি রুমে রুমে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। বিকাল ৫টার দিকে তিনি ইসি সচিবালয় ত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন আউয়াল কমিশন।

বিদায়ের আগে ব্রিফিংয়ে লিখিত ভাষণে ‘নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে’ কিছু প্রস্তাব দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাব সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে।

সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।’

ভাষণের শুরুতে দেশের প্রতিটি নির্বাচনের ইতিহাস তুলে ধরেন হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল।

১৯৯১ সালের নির্বাচন রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন, সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীন হয়েছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি উল্লেখ করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। আসন পেয়েছিল মাত্র ৬টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীন। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না-করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন, কী কারণে, কত দিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে; দলের মধ্যে নয়।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচন সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছি। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না।

নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে; মধ্যে হয়নি। উইথইন হয়েছে, নট বিটুইন। নিজেদের কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ায় নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম