Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ব্রোকারেজ হাউজের সেরা জালিয়াতি

মশিউর সিকিউরিটিজ থেকে আত্মসাৎ ১৬১ কোটি টাকা

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মশিউর সিকিউরিটিজ থেকে আত্মসাৎ ১৬১ কোটি টাকা

বিনিয়োগকারীদের ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মশিউর সিকিউরিটিজ। এর মধ্যে গ্রাহকের সমন্বিত হিসাবে ঘাটতি (সিসিএ) ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার বিক্রি করে নিয়েছে ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একক কোনো ব্রোকারেজ হাউজের এটিই সবচেয়ে বড় জালিয়াতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জমা দেওয়া ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

তবে যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে আরও তথ্য মিলেছে। এ জালিয়াতিতে জড়িতদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে যুগান্তর। এর মধ্যে আছে ব্রোকারেজ হাউজটির পরিচালনা পর্ষদ, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, ডিএসইর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ এবং বিএসইসির সাবেক নীতিনির্ধারকদের সম্পৃক্ততা। তবে ইতোমধ্যে ব্রোকারেজ হাউজটির ব্যাপারে বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে বর্তমান কমিশন। এর মধ্যে আছে মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন, ‘ফ্রি লিমিট’সহ দেওয়া সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা, পরিচালকদের ব্যাংক ও বিও হিসাব স্থগিত এবং জড়িত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশ থেকে পালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ। বিএসইসি বলছে, তদন্তের পর আইন অনুসারে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, এর আগে কমিশনকে পরিদর্শনের জন্য ডিএসইকে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটি ওইভাবে হয়নি। এরপর তাদের রিমাইন্ডার দিয়ে পরিদর্শন করানো হয়েছে। এরপরও বিএসইসি একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়ে দিয়েছে। এ তদন্ত রিপোর্ট এলে প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে মশিউর সিকিউরিটিজের স্বত্বাধিকারী শেখ মোগল জান রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো সাড়া মেলেনি। এর আগে ডিএসইর তিনটি ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের ৩৯২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএল সূত্রে জানা যায়, মশিউর সিকিউরিটিজে বিও হিসাব প্রায় ২ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় বিও হিসাব প্রায় ৪৪ হাজার। অর্থাৎ অন্যতম বিও অ্যাকাউন্টের বিবেচনায় অন্যতম বড় ব্রোকারেজ হাউজ এটি। এদিকে একজন গ্রাহক ব্রোকারেজ হাউজে শেয়ার কেনার জন্য যে টাকা জমা দেন, তা সুনির্দিষ্ট একটি হিসাবে রাখতে হয়। এ হিসাবকে বলা হয় ‘সমন্বিত গ্রাহক অ্যাকাউন্ট (সিসিএ)’। এ হিসাবের টাকা ব্রোকারেজ হাউজটি অন্য কোনো খাতে এমনকি মার্জিন ঋণ দেওয়ার জন্যও ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু গত ২০ আগস্ট ডিএসইর পরিদর্শন দল মশিউর সিকিউরিটিজে সিসিএতে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঘাটতি শনাক্ত করে। অর্থাৎ গ্রাহকের টাকা অন্য খাতে খরচ হয়েছে। এরপর ২৮ আগস্ট তা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আকারে কমিশনকে জানানো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন গ্রাহকের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা সরিয়েছে মশিউর সিকিউরিটিজ। ২৮ আগস্ট এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২৯ আগস্ট ব্যবস্থা নেয় কমিশন। তবে এর সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দায়িত্বে অবহেলা ও ডিএসইর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও এর আগে কখনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ এবং কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। আইন লঙ্ঘন করে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়।

ডিএসইর মার্জিন রেগুলেশন অনুসারে প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউজ প্রতিদিন ১০ কোটি টাকা ‘ফ্রি লিমিট’ সুবিধা পায়। অর্থাৎ এ পরিমাণ টাকার শেয়ার লেনদেন করলে তাকে কোনো জামানত রাখতে হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ২০২২ সালের ২২ মার্চ জারি করা কমিশনের নির্দেশনার ১৩৭টি ব্রোকারেজ হাউজে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা ঘাটতি চিহ্নিত করেছে ডিএসইর মনিটরিং অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগ। তবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দুটি কোম্পানিকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এগুলো হলো ধানমন্ডি সিকিউরিটিজ ও মশিউর সিকিউরিটিজ। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, বছরের পর বছর ডিএসইর দায়সারা দায়িত্ব পালন এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিনিয়োগকারীদের বিশাল অঙ্কের এ অর্থ আত্মসাৎ করে পার পেয়ে যাচ্ছিল ব্রোকারেজ হাউজটি। শেয়ার বিক্রির পর বিনিয়োগকারীরা টাকা চাইলে দিনের পর দিন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঘুরানো হয়। আবার কখনো চেক দিলেও তা ব্যাংকে জমা না দিতে অনুরোধ করা হয়। এরপর ডিএসই ও বিএসইসিতে অভিযোগ করেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী। এ ধরনের কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। তারা বলেছেন, মশিউর সিকিউরিটিজের ঘাটতি নতুন নয়। কিন্তু ডিএসই এবং বিএসইসিকে আরও আগে সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। এর আগে মশিউর সিকিউরিটিজকে বিশেষ সুবিধা দেয় কমিশন। ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ডিএসইর একটি দল হাউজটি পরিদর্শনে যায়। এ সময় ৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঘাটতি চিহ্নিত করে। কিন্তু ডিএসইর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দাখিল করার আগেই কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মশিউর সিকিউরিটিজকে আইনের আওতার বাইরে রেখে সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে। এতে হাউজটি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর ডিএসইর আরেক দল মশিউর সিকিউরিটিজ পরিদর্শন করে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ঘাটতি শনাক্ত করে। তিনদিন পর ২২ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাউজটির ওপর কমিশনের আইন অনুযায়ী যাবতীয় শর্ত আরোপ করে। কিন্তু পরের দিনই অবস্থান পরিবর্তন করে কমিশন। ঘাটতি সমন্বয়ের সময়সীমা ২০২৪ সাল অর্থাৎ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোসহ ফ্রি লিমিট সুবিধা বহাল রাখা হয়। আবার এ সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ২৪ জুন সুযোগ-সুবিধা আরও ৬ মাস অর্থাৎ চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আবার ঘাটতি থাকা অন্য প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডি সিকিউরিটিজের ৩০ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিশেষ সুবিধা পেয়েছে মশিউর সিকিউরিটিজ। ২০ আগস্ট ডিএসইর পরিদর্শন দল মশিউর সিকিউরিটিজে সিসিএতে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঘাটতি শনাক্ত করে। এ সময় গ্রাহকের শেয়ার বিক্রি করে ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য মিলেছে। এরপর ২৮ আগস্ট ডিএসই কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করলে আইনানুযায়ী কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২২ মার্চ জারি করা কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে সিকিউরিটিজের ‘ফ্রি লিমিট’ সুবিধা বন্ধ, শেয়ারহোল্ডার হিসাবে ডিএসই থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ বণ্টন স্থগিত, স্টক-ব্রোকার ও স্টক-ডিলার নিবন্ধন সনদ নবায়ন বন্ধসহ ব্রাঞ্চ-বুথ খোলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ও ঘাটতি থাকাকালীন বন্ধ থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশনের এক নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, কিছু ব্রোকারেজ হাউজের আর্থিক অবস্থা খারাপ মনে হওয়ায় তারা সেগুলো পরিদর্শন করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৪ মে ডিএসইকে চিঠি দেয়। কিন্তু ওই সময়ে কমিশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারও দুর্বলতা থাকায় পরিদর্শন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে ডিএসইকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। আবার ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট দেশজুড়ে আন্দোলনের কারণে হাউজগুলোয় পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত, ১২৪ কোটি টাকা ঘাটতি থাকার জন্য ২০২০ সালের ২৪ জুন ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, ১২৮ কোটি টাকা ঘাটতি থাকায় ২০২১ সালের ১৫ জুন বাংকো সিকিউরিটিজ এবং ১৪০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকায় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর তামহা সিকিউরিটিজের লেনদেন বন্ধ করা হয়। এখনো এসব হাউজ বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম