Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিজয়ের দিনে আশুলিয়ায় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ

গুলিবিদ্ধ লাশের স্তূপে পুলিশের আগুন

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গুলিবিদ্ধ লাশের স্তূপে পুলিশের আগুন

রক্তে ভেজা সারা শরীর, খালি পায়ে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন গুলিবিদ্ধ যুবক। তার রক্তে ভিজে গেছে পিচঢালা পথ। নিথর দেহে তখনও হয়ত টিপটিপ করে জ্বলছিল জীবন প্রদীপ। দুই পুলিশ সদস্য তার হাত ও পায়ের দিকে ধরে ভারী বস্তার মতো করে পাশের রিকশা ভ্যানে ছুড়ে দেন। ভ্যানে আগে থেকেই ছিল লাশের স্তূপ। সেখানে একটির ওপর একটি রক্তাক্ত লাশ চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। এর আগে পুলিশ গুলিবিদ্ধ মরদেহগুলো গুনে গুনে ভ্যানে তোলে। সর্বশেষ রাস্তা থেকে তুলে ভ্যানে ছুড়ে দেওয়া গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিটি তখনও জীবিত ছিলেন। তার নিথর দেহ ধীরে হলেও ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। পাশ থেকে কেউ বলছেন, ‘আগুন দিয়ে পুড়াই দিতে হইব।’

মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, গা শিউরে ওঠা ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তোলপাড় সৃষ্টি করা এ ভিডিওর ঘটনাটি কোথায়, কখন, কিভাবে ঘটেছে তা জানতে চান সবাই। ভিডিওটি নিয়ে বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং সাইটের পাশাপাশি অনুসন্ধান চালিয়েছে যুগান্তর। জানা গেছে, ঢাকার অদূরে আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকের সামনের সড়কের ঘটেছে এ বর্বর ঘটনা। ভাইরাল ভিডিওটির শেষদিকে পেছনের দেওয়ালটি পর্যবেক্ষণে আরও স্পষ্ট হয় লোকেশন। চোখে পড়ে দেয়ালের ডিজাইন ও একটি রাজনৈতিক পোস্টার। শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, আশুলিয়া থানার পেছনের একটি প্লটের নিরাপত্তা প্রাচীর এটি। ভিডিওটিতে যে পোস্টার দেখা যায়, তা স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার। স্থানীয়রাও নিশ্চিত করেন ঘটনাটি ৫ আগস্ট বিকালের। ওই স্থান থেকে পরে সাতটি দগ্ধ লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। তাদের পাঁচজনের পরিচয় পেলেও দুজনের পরিচয় মেলেনি।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক দোকানি বলেন, ‘দূর থেকে দেখেছি লাশের ভ্যানে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। পরে সেখান থেকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সাতটি মরদেহ বের করা হয়। যাদের পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-সাজ্জাদ হোসেন সজল, তানজিল আহমেদ সুজয়, বায়েজিদ, শুভ্র হুমায়ন ও স্কুলছাত্র আসশাবুর। তাদের মরদেহ বুঝে পেয়েছেন স্বজনরা। বাকি দুজনের পরিচয় না পাওয়ায় স্থানীয় আমতলা এলাকায় কবর দেওয়া হয়।’ স্থানীয়রা মনে করছেন, লাশের পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

নিহত আসশাবুরের বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ভ্যানে উঠিয়ে আগুন দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিল নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও হয়নি আমাদের।

নিহত বায়েজিদের স্ত্রী বলেন, ‘৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি বায়েজিদ। সারা দিন ফোন দিছি কিন্তু ফোন বন্ধ পাইছি। পরের দিন লাশ পাওয়া গেছে।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মানুষ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

এদিকে ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করে বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দিন শিশির জানান, ঘটনাটি ৫ আগস্টের। ঢাকার আশুলিয়া থানার নিকটবর্তী বাইপাইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশের গলি দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর থানা ভবনের আগের জায়গায় ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভিডিওটি আশুলিয়া থানার সামনের বাচ্চু মিয়ার ভবনের ছাদ থেকে রেকর্ড করা। রনি আহমেদ নামের এক ভাড়াটিয়া ভিডিওটি রেকর্ড করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটি পোস্ট করেন। পোস্টটি মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। রনি আহমেদ বলেন, বিকালে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে সেখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিলেন। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলেন। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওয়ানা হন। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসেন।

সরেজমিন আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানার পাশেই ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে গুলিবিদ্ধ ৭ জনের মরদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পরে পুলিশ লাশগুলো একত্রিত করে ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখে। এরপরে ঘটে আরও মর্মান্তিক ঘটনা।

ওই ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে বিকালে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেট বন্ধ করে দেন। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা বাজে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। তারা থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এএফএম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। গুলি লোড করতে বলেন। একথা শুনে উপস্থিত ছাত্র-জনতা আরও চড়াও হন। আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন থানা ভবন থেকে বেরিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান। পরিস্থিতির অবনতি হলে একপর্যায়ে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে লোকজন দৌড়ে পালায়।

পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার কোয়ার্টারের গেটের অপর পাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার। এর মালিক ফাহিমা আক্তার বলেন, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিল পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যায়। পরে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে বলে জানান তিনি।

আফজাল হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার সময় কারও কারও হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। অনেকে সিভিল ড্রেসে ছিলেন। অনেকের হাতে অচেনা অস্ত্রও দেখেছি। তারা গুলি করতে করতে বের হন। কখনো গুলি বন্ধ করেননি। মেইন রোডে এসে একটি ভ্যানে আগুন দেন। ওই ভ্যানেও ৫ থেকে ৬টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ ছিল। বিকালে যারা গুলিতে মারা গেছেন তাদের ওই ভ্যানেই রাখা হয়েছিল। তারা নির্বিচারে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়েছে, গুলি থামায়নি। অলিগলি, রাস্তায়, বাসাবাড়ি যেখানে খুশি সেখানেই গুলি করেছে পুলিশ। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক পথচারী বলেন, পুলিশ থানা রোড থেকে গুলি করতে করতে সোহেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। তখন গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। তখন মানুষ বাসাবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। রাত তখন ৯টার বেশি বাজে। পুলিশ গুলি করতে করতে সামনের দিকে হেঁটে গেছে। এভাবে তারা পল্লী বিদ্যুৎ পর্যন্ত চলে যায়। এই সময়ে অনেক মানুষকে গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি।

ভিডিওতে ভ্যানে তোলা কয়েকটি মরদেহের স্তূপের পাশে পুলিশকে হাঁটাহাঁটি করতেও দেখা গেছে। তাদের একজনের পরিচয় ইতোমধ্যে শনাক্ত করা গেছে। তিনি ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ওই পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সেদিন ‘ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লা হিল কাফী স্যারের নির্দেশে আমরা আশুলিয়ায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে ৫ আগস্ট আমরা প্রাণে রক্ষা পাই। নইলে আমাদেরকেও মরতে হতো।’

এ বিষয়ে পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সরকারি মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম