প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দলগুলোর অভিন্ন মত
আগে সংস্কার পরে নির্বাচন
দ্রুতই আগামী বাংলাদেশের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস * প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুবারের বেশি নয়-জাতীয় পার্টি, হেফাজতে ইসলামসহ সাত ইসলামি দল * তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় গণফোরাম * আ.লীগকে নিষিদ্ধের দাবি এলডিপির * বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তার দোসরদের বিচারের প্রস্তাব ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর দেশটাকে নতুন করে সাজাতে ব্যর্থ হয়েছি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরেও দেশ গঠনে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এবার ব্যর্থ হতে চাই না। শহিদদের বিনিময়ে আজ যে মুক্ত বাতাস, তা যাতে জনগণ উপভোগ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আজ হোক কাল হোক জাতীয় নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। তবে সংস্কার করার আগে নির্বাচন কোনো অবস্থাতে বাঞ্ছনীয় নয়। তাই আগে সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। না হলে আগামীতে আবার স্বৈরাচারের জন্ম হবে বাংলাদেশে।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় পার্টি, গণফোরামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা ৩টায় শুরু হয় খেলাফত মজলিশের দুই অংশের সঙ্গে প্রথম মতবিনিময় সভা। এরপর পর্যায়ক্রমে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক দলের মতামত ও প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কী বলেছেন জানতে চাইলে নেতারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এটাই বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেকটা বিষয়ে। একজন উত্তর দিকে গেল, আরেকজন দক্ষিণ দিকে গেল-তা হলে তো দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। বৈঠকে একেক দল একেক ধরনের দাবি তুললেও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলে জানিয়েছেন নেতারা। সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা আছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কবে নির্বাচন করবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিচ্ছে না।
এদিকে এসব বৈঠকের পর রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, দ্রুতই আগামী বাংলাদেশের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন উপপ্রেস সচিব আজাদ মজুমদার। শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোর কাছে জানতে চেয়েছেন সংবিধান নতুন করে লেখা হবে, নাকি সংস্কার করা হবে। অনেকেই বলেছেন ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ভেতরে ভাগ করে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ও নরেন্দ্র মোদি আগমনের সময় কত মানুষ মারা গেছেন তা নতুন করে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। যাতে জনগণ জানতে পারবেন কতজন মারা গেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের রুপরেখা, নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কী হবে-তা জানতে চেয়েছে। দ্রুতই আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস। মাহফুজ আলম আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই রূপরেখা দেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে সরকারের মেয়াদ ঠিক হবে। একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৩ দিন পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিকদের বাদ রেখে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনী আলোচনা করে এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার ৪ দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১২ ও ১৩ আগস্ট বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এনডিএম, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন।
প্রথম দফার ওই আলোচনায় কয়েকটি দল ও জোট বাদ পড়েছিল। কয়েক দিন ধরে দলীয় কর্মসূচিগুলোয় অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়ে আসছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়েও জোর দিচ্ছিলেন। বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির মহাসচিব নানা আশঙ্কার কথাও জানান।
তিনি এ বিষয়ে ‘এক-এগারো’ হিসাবে পরিচিত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। পরদিনই বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠকটি হয়। এতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির তিনজন শীর্ষ নেতা অংশ নেন। বৈঠকেও বিএনপির নেতারা দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত সংস্কার করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার তাগিদ দেন। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
জাতীয় পার্টি : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের আগেই প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করাসহ বেশকিছু প্রস্তাব দেয় জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে রয়েছে-রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দুবারের বেশি একই ব্যক্তি যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তার বিধান করা। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা। জাতীয় সংসদে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা। বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তার সঙ্গে ছিলেন-সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব অ্যাডভোকেট মজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাশরুর মওলা এবং মনিরুল ইসলাম মিলন।
বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু যুগান্তরকে বলেন, দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার নির্বাচিত সরকার করতে চায় না। আমাদের চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন আছে।
দেশের মানুষ আশা করে বর্তমান সরকার কাজগুলো করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। এছাড়াও আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। সংসদ নেতা যেন প্রধানমন্ত্রী না হন সেই দাবি তুলে ধরে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দুবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন। তিনি আরও বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে আরও উন্নত হয়, সেই উদ্যোগ নিতে বলেছি।
এছাড়াও জনগণের কাছ থেকে যেসব দাবি আছে, প্রধান উপদেষ্টাকে সেসব সংস্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন জানিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, সংস্কার করে তারপর নির্বাচন। যেটুকু সময় লাগে সেটুকু সময়কে জাতীয় পার্টি সমর্থন করে। সংবিধান অনুযায়ী যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেসব নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার যে ভালো কাজগুলো করবে, সেটা অনেক সময় করে না। স্বাধীনতার পর থেকে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই কম-বেশি ভুলত্রুটি করেছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের অনেক ভুলত্রুটি আছে। আগামীতে যাতে নতুন কোনো ভুল না হয়, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।
এদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন গণফোরাম নেতারা। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন-মোস্তফা মহসীন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট এসএম আলতাফ হোসেন, ডা. মিজানুর রহমান, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিব উদ্দিন আবদুল কাদের এবং মোশতাক আহমেদ।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণফোরাম নেতা ডা. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, বৈঠকে গণফোরামের পক্ষ থেকে ২০টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুবারের বেশি নয়, সংস্কার করে নির্বাচনের পক্ষে সাত ইসলামি দল : হেফাজতে ইসলামসহ সাতটি ইসলামি দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন। বৈঠক শেষে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক একথা বলেন।
তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলোর এমন প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা একমত পোষণ করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের দিকে চলে যেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। বৈঠকে হেফাজতে ইসলামসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম এবং খেলাফত আন্দোলনের নেতারা যোগ দেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগকারীদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সেজন্য আসনভিত্তিক বিজয়ী সংসদ-সদস্যদের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা।
প্রার্থীদের নিজস্ব প্রচারণার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা। যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা। এছাড়াও সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি জানিয়ে তারা বলেছেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। তাই এ ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা বন্ধ করা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের বিধান করা। সংসদ-সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা।
বিচার ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা। বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগ ও বিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা সংযোজন করা। এছাড়াও পুলিশ এবং প্রশাসনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহারের পথ বন্ধ করা এবং কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন এবং নীতি প্রণয়ন না করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
বৈঠকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতৃত্ব দেন দলটির আমির ইউসুফ আশরাফ। তার সঙ্গে মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ছাড়াও ছিলেন যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি। হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব দেন মহাসচিব সাজেদুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল হক, মুনীর হোসেন কাশেমী।
নেজামী ইসলামের নেতৃত্ব দেন দলটির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা আশরাফুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন মহাসচিব মাওলানা মোমিনুল ইসলাম। খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েবে আমির মজিবুর রহমান হামিদী। খেলাফত মজলিসের নেতৃত্ব দেন দলের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ। তার সঙ্গে ছিলেন দলটির মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের, নায়েবে আমির সাখাওয়াত হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম-মহাসচিব মুনতাসীর আলী এবং প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন।
ইসলামী আন্দোলনের ১৩ প্রস্তাবনা : গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ১৩টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দলটির আমির মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। তাদের প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির ফয়জুল করীম, মহাসচিব ইউনুস আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান এবং যুগ্ম-মহাসচিব আশরাফুল আলম। খেলাফত মজলিসের নেতৃত্ব দেন দলের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ। তার সঙ্গে ছিলেন দলটির মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের, নায়েবে আমির সাখাওয়াত হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম-মহাসচিব মুনতাসীর আলী এবং প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন।
দলটির প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে-বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা। গত ১৬ বছরে যেসব হত্যা, গণহত্যা, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে সেসবের বিচার। এক্ষেত্রে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করা। তদন্তসাপেক্ষে দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীদের সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা এবং পাচার করা টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া। যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং দুর্নীতি ও টাকা পাচারের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।
এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের যেসব কর্মচারী আইন, সংবিধান, শপথ লঙ্ঘন করে অপেশাদার আচরণ করেছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনটি ভুয়া নির্বাচন করেছে। এ তিনটি অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনাকারী নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা তাদের অবৈধ কাজের কুশীলব ছিলেন তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করা। যাতে ভবিষ্যতে কেউ অবৈধ নির্বাচনের সাহস না করে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে ইসিকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যম-এ পাঁচটি ক্ষেত্রে আমূল এবং ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। ইসলামী আন্দোলন প্রত্যাশা করে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরন ও প্রক্রিয়া কী হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতিদ্রুত প্রকাশ করা এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব বাংলাদেশ জাসদের : বর্তমান সংবিধানের আলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জাসদ। দলটির সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কার একটা বড় কাজ। রাষ্ট্রের জন্য পুলিশকে তৈরি করা, কালো আইন বাতিল। পুরো বিচারব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। চুরি, দুর্নীতি সামাল দিতে হবে উল্লেখ করে জাসদের এই নেতা বলেন, দণ্ডিত দুর্নীতিবাজরা যাতে কোনোদিন নির্বাচনে আসতে না পারে।
কালোটাকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে রিসাইকেল না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। দলটির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর দেশটাকে নতুন করে সাজাতে ব্যর্থ হয়েছি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরেও দেশ গঠনে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এবার ব্যর্থ হতে চাই না। শহিদদের বিনিময়ে আজ যে মুক্ত বাতাস তা যাতে জনগণ উপভোগ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। বাংলাদেশ জাসদের প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন ডা. মুশতাক হোসেন, আবদুল কাদের হাওলাদার এবং কাজী সদরুল হক।
অন্যান্য দল ও জোটের নেতারা যা বললেন : ১২ দলীয় ঐক্য জোটের মুখপাত্র ও বিএলডিপির নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রধান বলেন, উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে শহিদ আবু সাঈদ নামকরণ করতে এবং মুগ্ধকে স্মরণ করার জন্য উত্তরাকে মুগ্ধনগর করার জন্য প্রস্তাব দেন।
এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল যেন বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া না হয়। তার নিশ্চয়তা দাবি করেন। জোটের ও জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ছাড়াও প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন-শরিক জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহিউদ্দিন ইকরাম, লেবার পার্টির একাংশের ফারুক রহমান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) একাংশের তাসমিয়া প্রধান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির একাংশের শামসুদ্দিন পারভেজ এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের একাংশের অ্যাডভোকেট শাহ আহমেদ বাদল।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের দাবি এলডিপির : লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশ নেয়। ৮৩ দফা প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়েছেন বলে জানান এলডিপি প্রধান। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য একমাত্র অস্ত্র হলো একটা ফোরকাস্ট দিয়ে দেওয়া। এটা ছয় মাস পরেও হতে পারে, নয় মাস পরেও হতে পারে।
সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা আমরা বলেছি। কিন্তু নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। তবে সংস্কার করার পূর্বে কোনো নির্বাচন কোনো অবস্থাতে বাঞ্ছনীয় নয়। সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন-জানতে চাইলে এলডিপি চেয়ারম্যান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এটাই বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেকটা বিষয়ে।
আমি উত্তর দিকে গেলাম, আপনি দক্ষিণ দিকে গেলেন তা হলে তো দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। দেশে গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে অলি আহমেদ বলেন, জামায়াতকে যদি ছোট ছোট তুচ্ছ কারণের জন্য তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যায় আমাদের হাজার ছেলেমেয়েকে হত্যা করার জন্য, ১৫ বছর কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গুম করার জন্য তাদের (আওয়ামী লীগ) বাতিল হবে না। এটা বাতিল করা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে আগামীতে আবার স্বৈরাচারের জন্ম হবে বাংলাদেশে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বে এলডিপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন রেদোয়ান আহমেদ, নেয়ামূল বশির, নুরুল আলম তালুকদার এবং আওরঙ্গজেব বেলাল। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতারা। এতে নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) একাংশের খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের এটিএম গোলাম মওলা চৌধুরী, এনডিপির আবু তাহের, বাংলাদেশ ন্যাপের শাওন সাদেকি, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম মতবিনিময়ে অংশ নেন।