শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি
রাঘববোয়ালের নাম নেই তালিকায়
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিল্প জগতে ‘রুবি ফুড প্রডাক্টস লি.’ খুব পরিচিত না হলেও ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে ৭ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। একইভাবে ১৩৫২ কোটি টাকা নিয়েছে কেয়া কসমেটিকস লি.। ১২৫১ কোটি টাকা নিয়েছে মাহিন এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া হাজার কোটি টাকার উপরে নামে-বেনামে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন আরও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে-এফএমসি ডকইয়ার্ড লি., গ্লাক্সি সুয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লি., রিমেক্স ফুটওয়্যার, মেরিন ভেজিটেবল অয়েল ইত্যাদি। প্রতিটি কোম্পানিই এখন ঋণখেলাপি।
এসব ছাড়াও ব্যাংক খাতে শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপির তালিকায় আছেন আরও অনেকে। এ তালিকা ২৪ জুন সংসদ অধিবেশনে উত্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। এ তালিকা এখন যুগান্তরের হাতে। কারা আছে এ তালিকায়, কত টাকা ও কিভাবে হাতিয়ে নিয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত লুটের অর্থের গন্তব্যস্থল কোথায় তা যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। আজ প্রথম পর্বে তালিকা প্রকাশ করা হলেও কাল থাকছে ঋণের অর্থ কারা এবং কিভাবে কোথায় নিয়ে গেছেন। সর্বশেষ থাকছে অর্থ ফেরত আনার সরকারের রোডম্যাপ।
সূত্রমতে, ঋণখেলাপিদের তালিকার হিসাবটি জুন পর্যন্ত। ২৪ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এ তালিকা তৈরি করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে পাঠায়। কিন্তু ওই তালিকায় রাঘববোয়ালদের কোনো নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এর আগেও ২০২৩ সালের শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই সময় খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৬ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। সেখানেও কোনো বড় খেলাপির নাম আসেনি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৯ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একটি সুবিধা দেওয়ার কারণে অনেক বড় ঋণখেলাপি আড়ালে রয়ে গেছে। সেটি ছিল পরিশোধযোগ্য ঋণের ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে নাম কাটানো যাবে। এই সুবিধা ব্যবহার করেই রাঘববোয়ালরা তালিকা থেকে বের হয়ে গেছে। যে কারণে শীর্ষ ৩০ খেলাপির তালিকায় বেক্সিকো ও এস আলম গ্রুপসহ আরও অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের অঙ্ক হাজার হাজার কোটি টাকা।
শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অস্তিত্বহীন, কাগুজে ও বেনামি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ঋণের টাকায় কারখানার বহুতল ভবন নির্মাণ হলেও চালু হয়নি, ঋণের অর্থে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। চালু ফ্যাক্টরি দেখিয়ে ঋণ নেওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের ঋণের অর্থ। ঋণ নিয়ে জাল-জালিয়াতির ঘটনায় একাধিক খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
শীর্ষ খেলাপির তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম আট খেলাপি প্রত্যেকেই এক হাজার কোটি টাকার উপরে ঋণ নিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে এফএমসি ডকইয়ার্ড লি., খেলাপি ঋণের অঙ্ক এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, গ্লাক্সি সুয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লি., যার খেলাপি ঋণের অঙ্ক এক হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। এছাড়া এক হাজার ৮৪ কোটি টাকা ঋণখেলাপি রিমেক্স ফুটওয়্যার লি., প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লি. যার খেলাপি ঋণের অঙ্ক এক হাজার ৭১ কোটি টাকা এবং মেরিন ভেজিটেবল অয়েল লি. (১০৫৭.৪০ কোটি টাকা)।
শীর্ষ ৩০ খেলাপি ঋণের তালিকার মধ্যে পর্যায়ক্রমে আছে মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স (প্রা.) লি. (৯৫৮ কোটি টাকা), জাকিয়া কটনটেক্স লি. (৮৭২ কোটি টাকা), রূপালি কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লি. (৮৭৬ কোটি টাকা), ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস লি. (৮৫৫ কোটি টাকা), ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লি. (৮৩৭ কোটি টাকা)। এছাড়া সুপ্রভ স্পিনিং লি. (৮৩১ কোটি টাকা), সুপ্রভ কম্পোজিট নিটওয়্যার লি. (৭৬০ কোটি টাকা), ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন লি. (৭৯৮ কোটি টাকা), এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লি. (৭৯৩ কোটি টাকা), রাদিউম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লি. (৭৮৩ কোটি টাকা)। তালিকায় আরও আছে সিমরান কম্পোজিট লি., (৭৮০ কোটি টাকা), জেকওয়ার্ড নিটওয়্যার লি. (৭৭৯ কোটি টাকা), কোয়ানটুম পাওয়ার সিস্টেম লি. (৭৫৭ কোটি টাকা), এসএম জুট ট্রেডিং (৭৪৯ কোটি টাকা), রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লি. (৭৩১ কোটি টাকা)। এছাড়া শীর্ষ তালিকায় আরও যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-জুট টেক্সটাইলস মিলস লি. (৭২০ কোটি টাকা), ব্রোডওয়ে রিয়েল এস্টেট লি. (৬৬৯ কোটি টাকা), গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ লি. (৬৬৬ কোটি টাকা), বেনিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. (৬৬২ কোটি টাকা), সুপ্রভ রোটার স্পিনিং লি. (৬৫২ কোটি টাকা), সাদ মুসা ফ্রেবিক্স লি. (৬৫১ কোটি টাকা) এবং সিদ্দীক ট্রেডার্স (৬৪৯ কোটি টাকা)।
ঋণখেলাপিদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ১২ আগস্ট যুগান্তরকে জানান, আমাদের প্রধান কাজ অস্থিরতা কমিয়ে ব্যাংকগুলো সচল করা এবং ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। এরপর ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করার বিষয়টি দেখা হবে। কমিশন গঠনের মধ্যে ঋণখেলাপিদের বিষয়টিও আসবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, ১৯৯৬-২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির তালিকা মেনটেইন করত। ওই সময়ে যারা শীর্ষ ঋণখেলাপি তাদের মধ্যে অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পলিসি মেকার ছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তিনি মনে করেন, ঋণখেলাপি, কর ফাঁকি ও মুদ্রা পাচার একই সেটআপের লোকজন করছে। ১৯৯৯ বা ২০০১ সালের হিসাবে ঋণখেলাপ ছিল মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সুতরাং এটি বেড়েই যাবে যতদিন পর্যন্ত ঋণখেলাপি শতকরা ২ ভাগ দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিল করবে এবং নিয়মিত গ্রাহক করবে ১০ ভাগ দিয়ে।
এদিকে শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এননটেক্স গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড, সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লিমিটেড, সিমরান কম্পোজিট নিট লিমিটেড, জ্যাকার্ড নিট টেক্স লিমিটেড, সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড। মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৪২৮৫ কোটি টাকা। এই গ্রুপের ১৮ প্রতিষ্ঠানের কাছে আরোপিত, অনারোপিত সুদসহ ব্যাংকের পাওনা ছিল ৮১৭৮ কোটি টাকা। আলোচিত এই গ্রাহক এননটেক্সের ৩৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান জ্যাকওয়ার্ড নিট টেক্স লি.র অবস্থান টঙ্গী গাজীপুরে। টঙ্গীর নিশাতনগর এলাকায় জামানত হিসাবে ১১৩ কাঠা জমি জামানত দেখিয়ে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রতি কাঠা জমির বাজার মূল্য ১ কোটি টাকা দেখিয়ে বন্ধকী দলিল সম্পাদন করা হয়। ওই কোম্পানিটি বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে ৭৭৮ কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়েছে। চার ব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।
এদিকে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের গাইডলাইনে সহায়ক জামানত হিসাবে সহজেই নগদায়নযোগ্য তরল সম্পদ বা স্থাবর সম্পত্তি (ক্রেডিট সুবিধার পরিমাণের দ্বিগুণ মূল্যের সম্পত্তি) জামানত হিসাবে রাখার নির্দেশনা আছে। কিন্তু সেটি অনুসরণ করা হয়নি নুরজাহান গ্রুপের মেরিন ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের ক্ষেত্রে। শুধু জামানত হিসাবে টিআরের সমপরিমাণ চেক গ্রহণ করেই উক্ত ঋণ দেওয়া হয়। বর্তমান এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ১০৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মেসার্স মেরিন ভেজিটেবলসের অনুকূলে প্রায় ৩২৭ কোটি ৪ লাখ টাকার ঋণপত্র ও ২২৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা ৬০ দিন মেয়াদে শর্ত সাপেক্ষে টিআর ঋণ মঞ্জুরের অনুমোদন দেয়া হয়। ঋণখেলাপি নুরজাহান গ্রুপের টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অনেক ঋণখেলাপি মামলা পরোয়ানা রয়েছে। মেরিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড, নুরজাহান সুপার অয়েল লিমিটেড, জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডসহ গ্রুপটির কমপক্ষে ২০টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ব্যবসায়িক লোকসানে পড়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে খেলাপি হয়ে গত পাঁচ-সাত বছরে গ্রুপটির বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে কেয়া কসমেটিকস লি. ঋণখেলাপি ছাড়াও কোম্পানির ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও (বিএসইসি) অনিয়ম ধরা পড়ে। এ নিয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন কেয়া কসমেটিকসের মালিক আবদুল খালেক পাঠান, তার স্ত্রী এবং তাদের তিন সন্তানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১৮৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকার বেশি সম্পদ অর্জন এবং ৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার বেশি সম্পদ গোপন করার অভিযোগে পাঁচটি মামলা করেছে। অন্যদিকে বৈধ আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৩৩ কোটি ৭৩ লাখ ৯ হাজার ২৪৫ টাকার সম্পদের সন্ধান পায় দুদকের অনুসন্ধানে।
মাত্র এক যুগ আগেও দেশের ৫ ভাগের ১ ভাগ ভোজ্যতেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের হাতে।
কিন্তু এখন সরকারের শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি তালিকার ৯ নম্বরে আছে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম। ইলিয়াস ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৯৫৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ঋণে জর্জরিত ইলিয়াস ব্রাদার্সের ১৩ পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত।