সুপ্রিমকোর্টে মামলার সংখ্যা ৬ লাখ
৪৩ লাখ মামলার পাহাড় আদালতে
আলমগীর হোসেন
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়।
বিষয়টি দেখে ফেলায় নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমকেও অপহরণ করা হয়। ৩ দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে সাতজনের লাশ পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় হওয়া দুই মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন নারায়ণগঞ্জের আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন দণ্ডিতরা।
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট আপিলের রায়ে ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল এবং অপর ১১ আসামির দণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া ৯ আসামির দণ্ড বহাল থাকে। সাত খুনের মামলাটি গত ৭ বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু এ মামলা নয়, এমন অনেক মামলা রয়েছে বছরের পর বছর সাক্ষ্যগ্রহণের অভাবে বিচারকাজ আটকে আছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণের মধ্যে রয়েছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, দেরিতে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া এবং সাক্ষী হাজির না হওয়া। ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা। সুপ্রিমকোর্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে সারা দেশের আদালতগুলোয় (সুপ্রিমকোর্টসহ) মামলার সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ। আর বর্তমানে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখের কাছাকাছি।
৫ বছরে মামলা বেড়েছে ৭ লাখ। এই ৪৩ লাখ মামলা নিরসনে দেশের অধস্তন আদালতগুলোয় বিচারক রয়েছেন মাত্র দুই হাজার। আর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ৬ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৭৫ জন বিচারপতি রয়েছেন। যা অন্যান্য সময়ের চেয়ে কম। এসব মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সুপ্রিমকোর্টের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মামলা নিষ্পত্তি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকার পতনের পর বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে কিছু বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সবকিছু স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০৪টি মামলা। এর মধ্যে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ৫০৪ মামলা। এছাড়া সুপ্রিমকোর্টে ৫ লাখ ৭০ হাজার। যাতে আপিল বিভাগে ২৬ হাজার ৫১৭ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭। আপিল বিভাগে থাকা মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৬ হাজার ৬৭, ফৌজদারি ১০ হাজার ২৭০ এবং আদালত অবমাননাসংক্রান্ত ১৮০টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি ৯৫ হাজার ৫৩, ফৌজদারি ৩ লাখ ২২ হাজার ৫৬৪ এবং রিট ১ লাখ ৬ হাজার।
জানা যায়, ঢাকা জেলার ৪০টি আদালতে দেওয়ানি ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৫টি, আর ফৌজদারি ৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৭৯টি মামলা বিচারাধীন। ঢাকার দ্বিতীয় অর্থ ঋণ আদালতে ১২ হাজার ১৪৭টি মামলা ঝুলে আছে। তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতে ঝুলে আছে ১১ হাজার ৭০টি মামলা। চতুর্থ অর্থ ঋণ আদালতে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৪৬৩টি। প্রথম অর্থঋণ আদালতে রয়েছে ৪ হাজার ১৮২টি মামলা। ৪টি আদালতে ৫ থেকে ১০ বছরের পুরোনো মামলা ১ হাজারেরও বেশি।
আলোচিত যত মামলা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা, শিশু রাজিব ও রাকিব হত্যা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা।
এছাড়া পার্বত্য শান্তিচুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল এবং মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা। আর উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, হলি আর্টিজান হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান হত্যা, আবরার হত্যা এবং রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির তাগিদ : মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জট নিরসনে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনো মেলেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না।