উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৃহস্পতিবার গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস -পিআইডি
দেশের মানুষকে গুম হওয়া থেকে রক্ষা করতে জাতিসংঘের গুম ও নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সনদে স্বাক্ষর করেন। এজন্য এক এক্স (টুইটার) বার্তায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটি।
এদিকে ওই বৈঠকে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বাংলাদেশ ফুটবল টিমকে সংবর্ধনা দেবে সরকার। পাশাপাশি বন্যার কারণে রপ্তানিমুখী যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার কার্যক্রমও চালানো হবে। হজের প্যাকেজ নিয়ে এক ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে।
তাই হজ খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকের পর পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, একটি স্বস্তি ও আনন্দের খবর হচ্ছে-জাতিসংঘের গুম ও নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই কনভেনশন ২০০৬ সালে গঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুম হওয়া থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষায় সরকার এতে যুক্ত হলো। আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্সে প্রবেশের সনদে স্বাক্ষর করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক উপলক্ষ্য। অন্যান্য উপদেষ্টা করতালি দিয়ে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
প্রসঙ্গত, বলপূর্বক গুমের শিকারদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবসের একদিন আগে এই সনদ স্বাক্ষরিত হলো। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা বলপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সপ্তাহের শুরুতে একটি কমিশন গঠন করে।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, এটা আমাদের মানবাধিকারকর্মীদের জন্য মাইলফলক। আমরা অনেকেই গুমের শিকার হয়েছি। এখন থেকে আর যেন কেউ কখনো নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কোনো বাহিনীকে দিয়ে কাউকে গুম করতে না পারে-সেজন্য কনভেনশনে সরকার স্বাক্ষর করেছে।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ করার অজুহাত, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি কাজ এবং সরকারের বিরোধিতা করা হচ্ছে-এমন কারণ দেখিয়েও গুম করতে পারবে না।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করা হবে। কারণ জাতিসংঘ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে তোমরা কেন এ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করছ না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করছি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছি। গুমের বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, বরাবরই গুমের বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে। অথচ দেশে অহরহ মানুষ গুমের শিকার হচ্ছে। আমরা আস্থার ভিত্তিটা স্থাপন করতে পেরেছি, এটাই আনন্দের এবং স্বস্তির বিষয়।
গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অনুস্বাক্ষরের ফলাফল কী এমন প্রশ্নে রিজওয়ানা হাসান বলেন-প্রথমত, যারা গুমের শিকার হয়েছেন তারা একটা সুরক্ষা পাবেন। দ্বিতীয়ত, সরকারি পর্যায় থেকে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিরুদ্ধমতকে দমন করতে গুম করে ফেলা-এখানেও একটা শক্ত ও পরিষ্কার বার্তা গেল এসব আর হবে না।
গুম সরকারের করার কথা নয় কিন্তু করছে, সে কারণেই আমাদের এখানে প্রকাশ্যে গুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হলো। সরকার কিংবা কোনো বাহিনীর জন্য তো গুম করার লাইসেন্স নেই। তাদের আইনগত এখতিয়ারও নেই।
বিভিন্ন মতামতকে দমিয়ে রাখার জন্য এ কাজগুলো করে এবং সেখানে কতগুলো যুক্তি দেয় যেমন-সরকারের বিরোধিতা করছে, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি কাজ করছে। এসব অভিযোগের বিষয় তো কখনো তলিয়ে দেখা হয় না।
এই চর্চা অবশ্যই বন্ধ হবে। আগে থেকে বন্ধ হওয়া উচিত ছিল। বন্ধ ছিল না বলে আমরা আজ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছি। কনভেনশনে যেসব বিধিবিধান আছে তা যতটুকু প্রয়োজন আমাদের আইনে অন্তর্ভুক্ত করব। কিছু হয়তো আছে, বাকিটুকু আমরা নিয়ে নেব।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের অর্থক্ষেত্রে সংস্কারের অংশ হিসাবে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু হয়েছে। কালোটাকা সাদা করার যে বিধি এবং রীতি সেটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগের মাধ্যমে সরকার যে টাকা আয় করে তা খুবই সামান্য। বরং মূল্যবোধটা অনেক বেশি বিকৃত হয়।
তাই কালোটাকা আর সাদা করার সুযোগ থাকছে না। এটা সরকারের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত। এছাড়া অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় রাখতে সরকার যা যা করা দরকার, সে কাজগুলো করতে শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, অতিদ্রুত সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিনাপ্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পরও বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা বৈধ করার প্রস্তাব পাশ করে সংসদ। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক সদস্য এর সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন।
জুলাই থেকে এক বছরের জন্য কালোটাকা সাদা করার এ সুযোগ রাখা হয়। মাঝে এ সুযোগ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এর আগে সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। পরের অর্থবছরে সেই সুযোগ আর রাখা হয়নি।
একই সঙ্গে প্লট, ফ্ল্যাট ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগও তুলে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রশ্ন ছাড়া জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া কর অনুযায়ী সেগুলো বৈধ করা যাবে। এমন সুযোগ বৈধ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে বলে তুলে ধরে বলা হচ্ছিল, এটি কর প্রদানের ক্ষেত্রে অসম ব্যবস্থার সূচনা করবে। অনেকে আর বৈধভাবে কর না দিয়ে পরে এ সুযোগ নেবেন।
কেননা একজন করদাতার ৩০ লাখ টাকা থাকলে ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু যিনি আগের বছরগুলোতে আয়করে যথাযথভাবে অর্থ প্রদর্শন করেননি তিনি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেই অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করে নিচ্ছেন। এতে নিয়মিত করদাতারা কর দিতে অনীহা দেখাতে পারেন। এছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগে যে কোনো ব্যক্তি আয়কর আইন মেনে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করতে পারেন। তখন তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ তো বাজেটের সময় রাখা হয়। ইতোমধ্যে অর্থবছরের তো ২ মাস চলে গেছে। তাহলে এখন কী করে তা বন্ধের ব্যবস্থা নেবেন-এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, এটা একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে। আগে যেমন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হতো। এখন একটি আদেশের মাধ্যমে উলটো বলা হবে। অর্থাৎ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকবে না।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সমন্বয়ের কথা এসেছে। বন্যার কারণে রপ্তানিমুখী যেসব শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের শ্রমিকদের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে সে ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে সহায়তার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ১ দিনের বেতন প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়েছেন। যারা জমা দেননি তারা জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, আমাদের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য হজ একটি বড় বিষয়। কিন্তু হজের ক্ষেত্রে একটা সিন্ডিকেট আমরা দেখতে পাই। হজের প্যাকেজের মূল্য অনেকটা বাড়িয়ে তোলে। হজের খরচ যাতে যৌক্তিকভাবে কমানো যায়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। হজের খরচ কত হতে পারে তা নয় বরং যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার কাজ চলছে। তবে হজের প্যাকেজটা যে বাড়তি এবং এটা যে কমানো সম্ভব তা প্রাথমিক বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছি বলেও জানান পরিবেশ উপদেষ্টা। তাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কার প্রস্তাব আসবে তা গ্রহণ করব। সে বিষয়ে একটি পদ্ধতির বিষয়ে কথা হয়েছে। আমাদের আগে একটি পদ্ধতি ছিল জিও এবং এনজিও কো-অর্ডিনেশন। অর্থাৎ সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়। সে সমন্বয়টা আবার চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এক মাসের মধ্যে কী কী কাজ সরকার করেছে তা নোট আকারে প্রস্তুত করে গণমাধ্যমকে দেওয়া হবে।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, আমাদের খেলার অঙ্গন থেকে দুটি ভালো খবর এসেছে। সার্ক অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৪-এ বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ ফুটবল টিমের জন্য সরকার একটি সংবর্ধনার আয়োজন করবে। আরেকটা হচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানকে হারিয়েছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে যে একটা উদ্যোগ এসেছে, এটাকে ধরে রাখার জন্য তাদের অভিনন্দন জানানো দরকার। উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে সব খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা এবং ক্রিকেট বোর্ডকে অভিনন্দন জানিয়েছি।
প্রশাসনে সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তাদের বিষয়ে করা এক প্রশ্নে রিজওয়ানা হাসান বলেন, যে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। যে কোনো সরকারকে তার কাজ চালিয়ে নিতে ভালো কিছু কর্মকর্তা তো দরকার হয়। যদি দেখি দক্ষতা আছে তাহলে তার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই।
আমরা কাজটা নিয়ে আগাতে চাই। আগের সরকারে যারা ভালো জায়গায় ছিলেন, এমন কাউকেই যদি না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে কাজ আগাবে কী করে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে জানানোর আবেদন করেন সরকারের এ উপদেষ্টা। আমরা আর আগে যারা ছিল তাদের নীতি যদি এক হয়ে যায়, তাহলে তফাতটা কী হলো। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জানানোর পরামর্শও দেন তিনি।