বিআইডব্লিউটিএ’র কাণ্ড
নিষেধাজ্ঞার পরও ২৯০ কোটি টাকায় ড্রেজার ক্রয় টেন্ডার
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একদিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ৪ আগস্ট। ওইদিন সারা দেশে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের হামলায় দেশ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভয়ংকর ওই পরিস্থিতির মধ্যেই ৪ আগস্ট একটি ফাইল উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ওই ফাইলে ২৯০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের চারটি কাটার সাকশন ড্রেজার, চারটি ক্রেনবোট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তাব করা হয়। বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী তোলা ওই প্রস্তাবটি সম্প্রতি অনুমোদন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। রোববার ওইসব নৌযান কেনার টেন্ডার নোটিশ নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় জলযান ক্রয়ের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব টেন্ডার আহ্বানে ওই নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। টেন্ডার আহ্বানের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এখানেই শেষ নয়, টেন্ডারে ‘বিশেষ’ শর্তও যুক্ত করা হয়েছে। ওই শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ কাজ পাওয়ার যোগ্য হবে না। অভিযোগ রয়েছে, নৌপরিবহণ খাতের প্রভাবশালী একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতেই এ টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-এর একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অপ্রয়োজনীয় এসব ড্রেজার ও জলযান কেনা হচ্ছে। সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের বহরে বর্তমানে ৪৫টি ড্রেজারসহ ৩৩০টি ড্রেজিং সংক্রান্ত জলযান আছে। জনবলের সংকট ও জ্বালানি তেলের অভাবে অনেক জলযান দীর্ঘদিন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় অলস পড়ে আছে। এছাড়াও ১২টি ড্রেজার এবং ৬৭টি জলযান নির্মাণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। বেসরকারি খাতেও শতাধিক ড্রেজার রয়েছে। তবুও বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতে এসব ড্রেজার ও ক্রেনবোটসহ যন্ত্রাংশগুলো কিনতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, আগামী জুনে প্রকল্প শেষ হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করার অংশ হিসাবে এসব নৌযান সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থেকে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এখানে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমরা শুধু এই প্রকল্প নয়, আরও কিছু টেন্ডার আহ্বান করেছি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে এসব টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো টেন্ডার আহ্বানের অনুমতি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় দেয়নি বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে কোনটি বহাল থাকবে, কোনটি সংশোধন হবে অথবা কোনটি বাতিল হবে, তা নির্ধারণ করবে সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো নির্দেশনা না থাকায় নতুন কোনো টেন্ডার আহ্বান করছি না। কোনো সংস্থা যদি টেন্ডার আহ্বান করে থাকে, সেটা তাদের নিজ দায়িত্বে করেছে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে যেসব জরুরি কার্যক্রমের নির্দেশনা পাচ্ছি, শুধু সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য অধীনস্থ সংস্থাগুলোকে বলা হচ্ছে।
জানা যায়, ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এসব ড্রেজার কেনা হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ১ হাজার ৫৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট টাকার ২৩.৩৩ শতাংশ। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে আগামী জুনে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও প্রকল্পের ওই সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রকল্পের আওতায় ৬৫টি ড্রেজার এবং ১৬১টি জলযান কেনার কথা।
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ড্রেজার ক্রয় : অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে অর্থনৈতিক সংকট ও রিজার্ভ কমে যাওয়ায় উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে ৪ জুলাই পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ। ওই পরিপত্রে জলযান কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ প্রকল্পের প্যাকেজ-২১-এর আওতায় ১৬৩ কোটি ৮০ লাখ টাকায় দুটি ২০ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজার, দুটি ক্রেন, আনুষঙ্গিক পাইপ-যন্ত্রপাতি এবং প্যাকেজ-২৩-এর আওতায় ১২৬ কোটি ১৭ লাখ টাকায় দুটি ১৮ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজার, দুটি ক্রেন ও আনুষঙ্গিক পাইপ-যন্ত্রপাতি কেনার জন্য পৃথক দুটি টেন্ডার আহ্বান করেছে।
আরও জানা যায়, এসব নৌযান কেনার টেন্ডার আহ্বানের প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গোপন করা হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, একটি বিশেষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারের উচ্চমহল থেকে ড্রেজার কেনার অনুমোদন এনে দেবে-এমন আশ্বাস দিয়েছে। জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, আমার জানামতে, অর্থ বিভাগের নিষেধাজ্ঞা প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া টেন্ডার মূল্যায়নের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে যাবে। যদি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে, তাহলে সরকার টেন্ডার বাতিল করতে পারবে।
যুক্ত করা হয়েছে বিশেষ শর্ত : টেন্ডার ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দুটি টেন্ডারে বিশেষ কিছু শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গত পাঁচ বছরে এক চুক্তির আওতায় ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির তত্ত্বাবধানে সফলভাবে ড্রেজার (ক্লাস ড্রেজার) নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত ড্রেজার ক্রয়ের টেন্ডারে ক্লাস ড্রেজার অথবা ক্লাস ভেসেল নির্মাণের শর্ত দেওয়া হতো। ওই শর্ত থাকলে বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকত। কিন্তু শুধু ক্লাস ড্রেজার নির্মাণের শর্ত দেওয়ায় বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের এই কাজ পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড এবং আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড। এ শর্তের কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পথ কমে গেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, সিপিটিইউ-এর একটি রায়ের আলোকে এ শর্ত দেওয়া হয়েছে। এ শর্তের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে না, বিষয়টি সত্য। যে মামলায় ওই রায় হয়েছে, তা আমরা চ্যালেঞ্জও করেছিলাম। তিনি বলেন, সামনে প্রি-বিড মিটিং হবে। ওই মিটিংয়ে কেউ অভিযোগ করলে টেন্ডারের শর্ত সংশোধনের সুযোগ আছে।
চলমান ১৮৯৪ কোটি টাকার কাজ : জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় ১৮৯৪ কোটি টাকার কাজ চলমান। এর আওতায় দুটি ২৮ ইঞ্চি ও ৮টি ২৪ ইঞ্চি আকারের কাটার সাকশন ড্রেজার, ১টি হপার ড্রেজার ও ১টি গ্রাব ড্রেজার, ১৭টি টাগবোট ও ১০টি ক্রেনবোট নির্মাণ করা হচ্ছে। বেশির ভাগ নৌযান নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ করতে পারছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে নতুন করে ড্রেজার ও জলযান কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।