Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

যুগান্তরকে পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা

আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়

Icon

হক ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়

পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান/ফাইল ছবি

বায়ু, নদী ও শব্দদূষণ কমানোসহ পাহাড় কাটা, পলিথিন ব্যবহার বন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে আর কোনো ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হবে না। যাদের অনুমতি আছে তাদের বিষয়েও নেওয়া হবে নতুন পদক্ষেপ। রাস্তায় চালকদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে হর্ন বাজানো। অনেক কারখানা অধিক লাভের আশায় বর্জ্য শোধনাগার বন্ধ রেখে নদী দূষণ করছে। অনুমোদন ছাড়াই কাটা হয়েছে পাহাড়। আইনের কঠোর প্রয়োগ করা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সেই কঠোর প্রয়োগের দিকেই যাচ্ছি আমরা। এ কাজে সরকারি এনফোর্সমেন্ট টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে স্থানীয় এলাকাবাসী, শিক্ষার্থী, সুধীজন, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমকর্মীদেরও।

সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আইনজীবী, পরিবেশবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিবেশ উপদেষ্টা হিসাবে তার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিকল্পনাগুলো দুভাগে ভাগ করেছি। প্রথমত, যে সংস্থাগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার সবকটিতেই বেশকিছু প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা আছে। একটি সামগ্রিক জটিলতা দেখা যাচ্ছে পদবঞ্চিতদের। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ কিছু মামলা আছে, পদোন্নতির বিষয় আছে। সেগুলো দেখা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি অগ্রাধিকার পরিকল্পনা করা আছে। আমি প্রাধান্য দিতে চাই বায়ুদূষণ কমানোতে। রাতারাতি বড় পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু বায়ুদূষণের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করব। পলিথিন ব্যাগ অনেক বড় একটি সমস্যা। সেটি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা অগ্রাধিকার পাবে। আরেকটি অগ্রাধিকারের জায়গা হলো বন ও পাহাড় উজাড় রোধ করা। বিগত সময়ে অনেক বন শুধু ক্ষমতার জোরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি কোনো একজন ব্যক্তিকেও দেওয়া হয়েছিল তার একটি চ্যারিটেবল ফান্ডের জন্য। এরকম তো হতে পারে না। বন প্রশাসনে একটি সিদ্ধান্ত আছে, সরকারপ্রধানের অনুমতি ছাড়া দেওয়া যাবে না। কিন্তু সরকারপ্রধান যে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেবেন না, প্রকল্প হলে বনের ওপর কি প্রভাব পড়বে তা না বুঝে দেবেন না এসব কথা বলা নেই। গাছ কাটার বিষয়ে কোনো বিধান নেই। শিল্পদূষণ এবং তার মাধ্যমে নদীদূষণ হচ্ছে। এসব বিষয়ে আইনপ্রয়োগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গুরুত্ব দিতে চাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে। যা শুধু আইন দিয়ে হবে না। শব্দদূষণ মূলত হয় হর্নের কারণে। হর্ন দেওয়ার বদভ্যাসের জায়গা থেকে চালকদের সরিয়ে আনতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে কি কি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, প্রথমত আন্তঃরাষ্ট্রীয় কারণেও দূষণ হয়। ঢাকার আশপাশে অনেক ইটভাটাই অবৈধ। সেগুলোর বিষয়ে আসছে শীতের আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের কোথাও আর নতুন করে ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হবে না। সরকারের নীতিই হলো ইটভাটা থেকে সরে ব্লকে যাবে। সরকারি কোনো স্থাপনার কাজে ২০২৫-এর পরে ইটের ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে-এই কথাটি রাখতে হবে। কিন্তু সরকারি কতগুলো কাজে ইটের প্রয়োজ হয়-যেমন রাস্তা। এক্ষেত্রে ইটের বিকল্প ভাবা হচ্ছে। আবার ইটভাটা মালিকদের অনেকের ব্যাংক লোন আছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত এমন ইটের ভাটার বিষয়ে কিভাবে কি করা যায় সেটি দেখা হবে। ইটভাটা থেকে সম্পূর্ণ উত্তরণের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে। সেজন্য দেখতে হবে ইটের বিকল্প হিসাবে রাস্তায় কি ব্যবহার করা যায়। বিকল্প হিসাবে ব্লকের জন্য যে ধরনের বালি প্রয়োজন তা নদী ড্রেজিং থেকে আনা সম্ভব কিনা সেটিও দেখতে হবে। গাড়ি থেকে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরোনো কিছু গাড়ি বন্ধ না করে উপায় নেই। এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরিবহণ মালিকরা অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে দূষিত বায়ু আপনার-আমার সবার আয়ু ৭ বছর কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা বাষুদূষণ নিয়ন্ত্রণের প্ল্যান দেখব, ফিন্যান্সিয়াল এলকশন দেখব এবং নিয়মিত মনিটরিং করব। পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকার পরও প্রকাশ্যে এর ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, অবাক করার মতো বিষয় দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রকাশ্যে তা উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। আইনটি খুব স্পষ্ট। মোড়ক উৎপাদনের জন্য কিছু অনুমোদন দেওয়া আছে। কিন্তু মোড়কের নামে পলিথিন উৎপাদন চলবে না। আমরা মার্কেট মনিটরিং করব। ২০০৪-২০০৬ সময়ে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেছে মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে। প্রথম আমরা বিভাগীয় শহরগুলো দিয়ে শুরু করব। পলিথিনের বিকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। দেশে কাগজ, পাট, কাপড় সবকিছুই আছে। বাজারে চাহিদা থাকলে বিকল্প এমনিতেই চলে আসবে। আমরা বলে দেব বিকল্প কি কি হবে। এখানেও আইন প্রয়োগে আমাদের কঠোর হতে হবে। নদীদূষণের বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বর্তমান প্রজন্ম দেশে দূষণমুক্ত নদী দেখেনি! এটিই সত্য কিন্তু বিশ্বাস করা যায় না। সব নদীকেই দূষণমুক্ত করতে হবে কিন্তু তা একবারে সম্ভব নয়। সেজন্য মানুষের কিছু দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। সবচেয়ে দূষিত কয়েকটি নদী যেগুলো দূষণমুক্ত করা অর্থনৈতিকভাবেও সম্ভব সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করব। সবচেয়ে দূষিত নদী কোনগুলো, কারা এগুলোকে দূষিত করে তার তালিকা প্রস্তুত শুরু হয়ে গেছে। সেখানেও আমরা মনিটরিং জোরদার করব। এক্ষেত্রে নদীর কাছাকাছি এলাকাবাসীকেও সম্পৃক্ত করব। এতে জানা যাবে কারা রাতের বেলা নদীতে দূষিত বর্জ্য ফেলছে। যুক্ত হবে শিক্ষার্থীরাও। দৃষ্টান্ত স্থাপন করব নদীকেও দূষণমুক্ত করা সম্ভব। কারখানাগুলো যেন অপরিশোধিত উপায়ে বর্জ্য না ফেলতে পারে সেটা মনিটরিং করা হবে। অনেক কারখানা তাদের শোধনাগার চালু রাখে না লাভ কমে যায় বলে। এখানেও আমাদের শক্ত হতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আগে উন্নয়ন পরে পরিবেশ সংরক্ষণের যে মানসিকতা তা বদলে দেব।

ঢাকায় সবুজায়নের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিলে কাজ করব। বন বিভাগের সঙ্গে ইতোমধ্যে নগর বনায়নের বিষয়ে কথা শুরু হয়েছে।

দেশের বনগুলোর সুরক্ষার বিষয়ে বলেন, বন বিভাগের দর্শনটা ঠিক করতে হবে। তাদের গাছ রোপণের বিষয়টি সব সময় অপছন্দ করি। মৎস্য বিভাগ তো মাছ চাষ করে না। বন বিভাগ কিভাবে সমাজকে ক্ষমতায়িত করবে সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আছে। রাজনৈতিক কারণেও এটি হয়েছে। সোনাদিয়ার মতো প্রাকৃতিক বন নিয়েছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। বন বিভাগ যখন দেখেছে উপরের কর্তাব্যক্তিরাও এরকম চাপ দেন তখন তাদের বনের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রভাবিত হয়। এসব বন্ধ করতে হবে। বন প্রশাসনকে জনমুখী এবং স্বচ্ছ কিভাবে করা যায় সবার সঙ্গে কথা বলেই উপায়গুলো বের করতে হবে।

অনেক নদীতে নাব্য নেই। যথেচ্ছাচার চলছে বালু উত্তোলনে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো মানুষ নিজেকে নদী থেকে আলাদা করতে পারে না। নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়েরও অনেক নেতিবাচক প্রভাব আছে। নদী থেকে ইট-পাথর তোলার অজুহাতও ড্রেজিংয়ের যুক্তিতেই দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। নদীর নাব্য অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। আন্তঃসীমান্ত কারণেও অনেক নদীর প্রবাহ নেই। আন্তঃসীমান্ত নদী, পানি উন্নয়ন বাঁধের অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক আছে। সেসব বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের পরিকল্পনা করব। সেক্ষেত্রে ভারত কতটুকু সমঝোতা করবে, কতটুকু করাতে পারব তা বড় বিষয়। কিন্তু নদীর বিষয়ে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই।

তিস্তার বিষয়ে বলেন, তিস্তার সমাধান দ্বিপাক্ষিক বিষয়। আমরা ভারতকে এতদিনে আমাদের বার্তাগুলো নিশ্চয়ই জানিয়েছি। আবার জানাতে হবে। তারপর করণীয় কি সেটা সরকারি পর্যায়ে, তিস্তানির্ভর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করা হবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে তিস্তার বিষয়টি ভারতের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ফেনী নদীর বিষয়ে চুক্তি করে আমরা ভারতকে পানি দিয়েছি। তিস্তার বিষয়ে তাদের দেশের মানুষের যেমন পানি প্রয়োজন ঠিক একইভাবে আমাদের দেশের মানুষও এই নদীর পানিতে অধিকার আছে। সেই অধিকারের কথাগুলো আমরা তুলে ধরব। পাহাড় কাটা রোধে করণীয় বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, পাহাড় না কাটাই একমাত্র সমাধান। ব্যক্তি এবং সরকারি দুভাবেই পাহাড় কাটা হয়েছে। এখন আর কাটার মতো পাহাড় নেই। কতগুলো চিহ্নিত জায়গা আছে যেখানে পাহাড় প্রতিবেশ ব্যবস্থায় হাতই দেওয়া যাবে না। যে পাহাড়গুলো আছে তার প্রতিটির গায়ে গায়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেব। ব্যক্তিগত পাহাড়ের মালিকদের চিঠি দেওয়া হবে।

ব্যক্তিগত হলেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কেউ পাহাড় কাটতে পারবেন না। কাটলে আইনগতভাবে দায়ী হবেন। পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে অভিযানে গেলে শ্রমিকদের ধরে আনা হয়। মালিক কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এখানেও এলাকার শিক্ষার্থী, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কাজ করবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম